বিভিন্ন জায়গাতে হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করা হচ্ছে। আমি একজন সনাতন ধর্মানুসারী। আমি যদি ভুলবশত নিজের অজান্তে রেস্টুরেন্টে গোমাংস ভক্ষণ করে ফেলি তাহলে শাস্ত্রমতে আমার পাপমোচনের স্বার্থে কি করা যাবে এবং আমি খুবই অনুতপ্ত তাই এই পাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী আছে?
আমার উত্তরঃ— উপায় আছে।
আপনার অজান্তেই এই ঘটনা ঘটেছে, আর আপনি অনুতপ্ত তাই নিজের দুশ্চিন্তা মুক্ত হোন। শাস্ত্রমতে আপনি গঙ্গাস্নান করেন। শাস্ত্রীয় মতে, নিজের অজান্তে গোমাংস ভক্ষণ করে ফেললে একদিন উপবাস পালন করলে সেই দোষ মুক্ত হয়। এটা আপনার অনিচ্ছাকৃত ভুল, গঙ্গাস্নান যথেষ্ট, অনুরোধ করবো বাইরে গেলে নিরামিষ আহারের চেষ্টা করুন।
হিন্দু ধর্মে গরু তথা গাভীকে পবিত্র জীব মান্য করা হয়েছে। পবিত্র জীবের মাংস ও পবিত্র। মলমূত্র পর্যন্ত পবিত্র বলা হয়েছে। বিষয় হচ্ছে পূর্বেকার মুনি ঋষিরা কলিযুগের প্রারম্ভ এই গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন।
এটা সম্ভবত চার হাজার বছর আগের ঘোষণা। ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণ থেকে উদ্ধৃত করে, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেনঃ—
"অশ্বমেধম গভালম্ভম সন্ন্যাসাম পাল-পৈত্রকম
দেবরেণ সুতোৎপট্টি কালাউ পাঞ্চ বিভারজয়েত"।
ব্যাখ্যাঃ— এই কলি যুগে, পাঁচটি কাজ একেবারে নিষিদ্ধ।
(১) যজ্ঞে ঘোড়া নিবেদন,
(২) বলিতে একটি গরু নৈবেদ্য বা খাদ্য,
(৩) সন্ন্যাসের আদেশ মেনে না নেওয়া,
(৪) পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে মাংস নিবেদন, এবং
(৫) একজন পুরুষ "তার ভাইয়ের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন।"
এটি ব্রহ্ম-বৈবর্ত পুরাণ (কৃষ্ণ-জন্ম-খণ্ড ১৮৫/১৮০) থেকে একটি উদ্ধৃতি।
পবিত্র বেদে থেকে জানতে চাই আমাদের নিজের অজান্তে ভুল কি শাস্ত্রমতে পাপ হবে?
আপনি যখন গোমাংস ভক্ষন করছিলেন তখন কি জানতেন যে সেটা তাই না। তাহলে আপনি তা খাননি মানে গোমাংস খেলে যেই অপরাধ হয়, যেই পাপ হয়, সেটা আপনি করেন নি। তাই এই পাপ শুরু হয়েছে, আপনার জানবার পর থেকে যখন আপনি সেটা খাচ্ছিলেন সে আপনাকে নিজে থেকেই পাপ, অনুতাপ ইত্যাদি দিয়ে দিয়ে পেটে যায়নি। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে সে নিজে কোনো পাপ বহন করে না।
স্বামী বিবেকানন্দের কথা পড়ে দেখতে পারেন। তিনি কর্মের ব্যাখ্যা দিতে পরিষ্কার করে বলেছেন, যে এর কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা হতে পারে না, যা সবার উপর সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে। একটি দেশে, একটি সংস্কৃতিতে এই গোমাংস ভক্ষন পাপ হবে, অন্য দেশে এটি সাধারণ আহার হবে। কোনো দেশে শুয়োরের মাংস খাওয়া পাপ হবে, আর কারো আহার হবে।
কোনটা ঠিক উত্তর দুটোই।
আপনাকে আপনার সংস্কৃতি যা দিয়েছে, আপনি সেটা পালন করবেন। দ্বিতীয় কথা হলো অজান্তে করা কাজের কোনো অপরাধ ধর্মেও নেই। তেমন বিধান নেই। হ্যাঁ অজান্তে করা কাজের ফলাফল আছে। কারণ তা নৈসর্গিক বিধান। যদি একটি ক্রিয়া হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু তা আপনার পাপ বা অপরাধ নয়।
একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করবো—
প্রথম ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা— আমি একজন সনাতন ধর্মানুসারী। ভুলবশত গোমাংস খেলে কি ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দেবেন?
আজ স্কুলের ক্যাফেটেরিয়ায় তারা বিন বুরিটো এবং গোমাংসের বুরিটো পরিবেশন করেছিলো। আমি লঞ্চ লেডিকে ইংরেজি এবং স্প্যানিশ উভয় ভাষাতেই (তিনি স্প্যানিশ বলতেন) মাংস ছাড়া বিন বুরিটো চেয়েছিলাম এবং তিনি বলেছিলেন এতে মাংস নেই তাই আমি খেয়ে ফেলেছি।
আমার বুরিটোর প্রায় অর্ধেক খাওয়ার পর, আমার বন্ধু লক্ষ্য করে এবং নিশ্চিত করে যে এর ভিতরে গোমাংস ছিল, তাই আমি তা আবর্জনার ট্রাশে ফেলে দিয়েছি। এবং মনে মনে ভাবতে থাকলাম হে ঈশ্বর আমি এটা কি করলাম এখন যে আমি অনুতপ্ত।
ঈশ্বর কি আমাকে শাস্তি দেবেন আমি যে একজন রক্ষণশীল হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ যিনি ভুলবশত গোমাংস খেয়েছেন এবং তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন ঈশ্বর কি আমাকে এটা জন্য শাস্তি দেবেন?
একজনের ব্যক্তিগত ঘটনা— আমার মা যখন ১৯৫৭ তে প্রথম বার বিয়ের পর দিল্লি আসেন রেলে করে, তখন ওনার বয়স ১৬-১৭ বছর। এবং সঙ্গে বাবা ও ঠাকুমা আর আমার ঠাকুমা ফল খাওয়ার পরেও স্টেশনে নেমে ঝুপ ঝুপ করে নিজের উপর জল দিয়ে পুরো ভিজে এসে বসে থাকতেন। দিল্লি আসার পর আমার মাকে খুব স্নেহ করতেন কিন্তু তার হাতের রান্না খেতেন না। এই নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় রহস্য উদ্ধার হয় যে মা রেলগাড়ীতে খেয়ে স্নান করেন নি। তাই ঠাকুমা তার হাতের রান্না আর খান না। এরপর আমার মা প্রায়শ্চিত্ত করলেন। তারপর তার পাপ শেষ হলো আবার সব স্বাভাবিক।
প্রায়শ্চিত্ত কি?
প্রায়শ্চিত্ত হলো আমাদের নিজের মনকে শুদ্ধ করা। প্রায়শ্চিত্ত (সংস্কৃত: प्रायश्चित्त) হলো সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ "ক্ষতিপূরণ, অনুতাপ, পরিহার"। হিন্দুধর্মে, এটি ধর্ম-সম্পর্কিত শব্দ এবং এটি স্বেচ্ছায় একজনের ভুল ও অপকর্ম, স্বীকারোক্তি, অনুতাপ, তপস্যার উপায় ও কর্মফলকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা বা হ্রাস করার জন্য ক্ষতিপূরণকে বোঝায়। একজনের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত অপকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্ত অন্তর্ভুক্ত। অনুতাপ, ক্ষতিপূরণ ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কিত প্রাচীন হিন্দু সাহিত্য বিস্তৃত, যার প্রাচীনতম উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার দৃষ্টান্তমূলক অর্থের মধ্যে রয়েছে নিজের অপকর্ম স্বীকার করা, তপস্যা, উপবাস, তীর্থযাত্রা এবং পবিত্র জলে স্নান, ধ্যান, যজ্ঞ, প্রার্থনা, যোগ, দরিদ্র ও অভাবীদের উপহার দেওয়া এবং অন্যান্য।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, প্রায়শ্চিত্ত করা হলো নিজের মনকে একপ্রকার শুদ্ধ করা। নিজেই স্বীকার করা যে আমি ভুল করেছি, এমন কিছু করেছি, এবং সেই কাজের উর্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়া। আপনি প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন যে আপনি তেমনটা অনুভব করছেন তাই এখন আর কি করবেন।
তবে এবার একটা প্রশ্ন করি, এখন কি আর সেই যুগ আছে?
আর এখন কি আর আমাদের কষ্ট হয় কাউকে মিথ্যা বলতে?
এখন কি আমরা কেউ বাড়ীতে অতিথি আসলে বিরক্ত হই না, তারপরেও কি আমরা আচার আচরণে বুঝতে দিই?
তাহলে কত বিষয়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, আর তা যদি করি তো অন্যরা তো আমাদের সাথে চলতে পারবে না। এবং এটা বলার অর্থ এইযে যেই কাজের জন্য আপনি অনুতপ্ত তার চেয়ে ঘোরতর খারাপ কাজ আমরা সকাল বিকাল বাড়িতে কিংবা বাড়ির বাইরে করে থাকি তাই না।
সনাতন ধর্ম বিশেষ কিছু নিয়ম কারণ ভিত্তি মেনে চলতে হয়। যেমন আপনি কি জানেন যে যখন আপনি পূজা করতে বসবেন, তখন আপনার স্ত্রীকে ডান দিকে বসতে হবে। কিন্তু বামা বলে পুরোহিতরা সব সময় বাম দিকে বসিয়ে দেন। অথচ তার নিয়ম পরিষ্কার উল্লেখ পেয়েছে, যে স্ত্রী কোন কোন কাজে বাম দিকে থাকবে। স্বামী স্ত্রী বাড়ী থেকে বেরুনোর সময় স্ত্রী আগে বের হতে হবে। স্বামী ঘর দরজা জানালা তালা দেবে। বাড়ীতে ফেরত আসতে সময় স্ত্রী আগে প্রবেশ করবে। স্বামী পরে স্ত্রী তালা খুলবে এরকম কি এখনো করেন?
আপনি যখন দান করবেন, তখন আপনার স্ত্রী আপনার বামে থাকবে। যখন বাড়ীতে কোনো পুজা করবেন, তখন অতি অবশ্যই আপনার স্ত্রী আপনার ডান পাসে বসবে। বিবাহের সপ্তপদিতে এই কথা আপনার স্ত্রী আপনাকে দিয়ে বলিয়েছে। এখন থেকে তুমি যখন পূজা করবে, তাতে আমাকে নিজের সঙ্গী করবে, এবং আপনি বলেছেন, ওম শ্বস্তি! তারপর তার স্থান বদল হলো।
এখন করেন কি, এইসব মেনে চলেন?
তাহলে যখন সেই সব না মেনেও আপনার মনে অনুতপ্ত বোধ আসে না, তাহলে একদিনের অজান্তে খাওয়া আপনাকে কখনোই এতটা অনুতপ্ত করেছে।
এটা দেখে এখন আমি নিজেই পাপ বোধে বিদ্ধ করছি। আমার তো তাহলে কোনো পথ রইলো না। এটা একটি বহুল প্রচলিত প্রশ্ন সনাতনীদের বহু বছর ধরেই।
আমরা কেউ ভুলে করে যদি গোমাংস খেয়ে ফেলি, (রেস্টুরেন্টে বা যেকোনো জায়গায় যেকোনোভাবেই) তাহলে কী ধর্মনাশ হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নটির সবচেয়ে বেশি সম্মুখীন হই আমরা গোমাংস ভক্ষণের ক্ষেত্রে। যেহেতু বাংলাদেশের রেস্টুরেন্ট বা অনেক প্রোগ্রামেই একসাথে গোমাংস ও অন্য মাংসের আয়োজন থাকে, অনেকেই ভুলবশত গোমাংস খেয়ে ফেলে। আবার চালাকি করে এবং মিথ্যা বলে হিন্দুদের গোমাংস খাইয়ে দিতে চাইবার প্রবণতাও খুব কমন বিষয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠদের "আমার অমুক হিন্দু বন্ধু/অমুক হিন্দু কলিগ তো খায় গোমাংস, তুইও খা একটু সমস্যা কী"
এটা বাস্তব জীবনে শোনেন নি এমন হিন্দু বাংলাদেশে খুবই দুর্লভ। বাস্তবে এটি খুবই অবান্তর একটি ধারণা। অগ্নির ধর্ম উত্তাপ, মানুষের ধর্ম সনাতন। ধর্ম একমাত্র জেনেবুঝে পাপ করলেই নাশ হয়। অজ্ঞাতসারে কোনো মাংস ভক্ষণ করলে ধর্মের নাশ হতে পারে না।
প্রাচীনকালে এমনও দেখা গেছে মুঘল/সুলতানী শাসকরা কোন হিন্দু রাজাকে ধর্মান্তরিত করার জন্য তাকে ছলেবলে গোমাংস খাইয়ে দিতো কারণ শাস্ত্রজ্ঞানহীন হিন্দুদের মধ্যে এরকম একটি অছ্যুৎ প্রথা প্রচলিত ছিল যে গোমাংস খেলেই ধর্ম শেষ! কিন্তু শাস্ত্র এ নিয়ে কী বলে?
আমি যদি না জেনে অজ্ঞতাবশত পাপ করে ফেলেছি, এখন আমি কি করতে পারি?
এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বশিষ্ট ধর্মসূত্রে।
ধর্মসূত্রের অন্তর্ভুক্ত বশিষ্ট সংহিতার ২৭ তম অধ্যায় অনুযায়ী বলা হয়েছে—
If a hundred improper acts, and even more, have been committed, and the (knowledge of the). Veda is retained, the fire of the Veda destroys all (the guilt) of that man just as a (common) fire consumes fuel. (Vasistha Dharmasutra 27/1)
যদি একশটি বা তারও বেশি অনৈতিক কাজ করা হয়ে থাকে এবং বেদের জ্ঞান বজায় থাকে, তাহলে বেদের আগুন সেই ব্যক্তির সমস্ত (অপরাধ) ধ্বংস করে দেয় ঠিক যেমন একটি (সাধারণ) আগুন জ্বালানি গ্রাস করে। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৭/১)
As a fire that burns strongly consumes even green trees, even so the fire of the Veda destroys one's guilt caused by (evil) deeds. (Vasistha Dharmasutra 27/2)
যেমন প্রচণ্ডভাবে জ্বলন্ত আগুন সবুজ গাছকেও গ্রাস করে, তেমনি বেদের অগ্নিও (অশুভ) কর্মের ফলে সৃষ্ট অপরাধকে ধ্বংস করে। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৭/২)
(বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৭/১-২ এর বিশ্লেষণ)—
যদি কোনো ব্যক্তি একশত বা এর অধিক পাপ করে, তবুও সে যদি বেদ স্মরণ করে; বেদের অগ্নিতে সেই সকল পাপ দূর হয়ে যায়। যেমন তীব্র অগ্নি এমনকি সবুজ গাছকেও পুড়িয়ে ফেলে, তেমনি বেদের অগ্নি তার মন থেকে সকল অপরাধবোধ দূর করে।
অর্থাৎ শুদ্ধ চিত্তে বেদ পাঠের মাধ্যমেই আমরা সকল পাপ থেকে মুক্ত হতে পারি। আমাদের মনের অপরাধবোধ দূর হয় কিন্তু একইসাথে সতর্ক করা হচ্ছে, বেদের এই ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে কারো উচিত নয় পাপকর্মে প্রবৃত্ত হওয়া ও আনন্দ উপভোগ। বেদপাঠ কেবল অজ্ঞতা আর সবার অবহেলাবশত হওয়া পাপ থেকেই পরিত্রাণ করে।
A men who remembers the Rig-veda is not tainted by any guilt, though he has destroyed these (three) worlds and has eaten the food of all, (even of the most sinful) men. (Vasistha Dharmasutra 27/3)
যে মানুষ বেদের স্মরণ করেন, তিনি কোনও অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হন না, যদিও তিনি এই (তিনটি) জগৎ ধ্বংস করেছেন এবং সকলের (এমনকি সবচেয়ে পাপী) মানুষের খাবার খেয়েছেন। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৭/৩)
If (a Mem) relies on the power of the Veda, he cannot find pleasure in sinful acts. Guilt (incurred) through ignorance and negligence is destroyed, not (that of) other (intentional offences). (Vasistha Dharmasutra 27/4)
যদি (একজন মানুষ) বেদের শক্তির উপর নির্ভর করে, তাহলে সে পাপকর্মে আনন্দ পেতে পারে না। অজ্ঞতা এবং অবহেলার কারণে (সৃষ্ট) অপরাধবোধ ধ্বংস হয়, অন্যান্য (ইচ্ছাকৃত অপরাধের) নয়। (বসিষ্ঠ ধর্মসূত্র, ২৭/৪)
(বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৭/৩-৪ এর বিশ্লেষণ)
অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে সকল মানুষ বেদের শক্তির উপর নির্ভর করে। আমরা বেদপাঠ করি বলে সেই গৌরবে ইচ্ছা করে পাপ করবো আবার পরে ক্ষমা চেয়ে মুক্ত হবো— ব্যাপারটা এমন ও না। আমাদের মনে রাখা উচিত, ঈশ্বর কখনোই কারো ইচ্ছাকৃত পাপ ক্ষমা করেন না, ঈশ্বর যদি পাপ ক্ষমা করেন, তাহলে তাঁর ন্যায় বিচারক স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে না। যার প্রতি পাপ করা হয়েছে, তার প্রতি অবিচার করা হয় ক্ষমা করে দিলে। সেজন্য বৈদিক সনাতন ধর্মে আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার সময় সর্বদা সংকল্পবিকল্পাত্মক বুদ্ধি চাই, সদ্গুণ চাই, অন্তর থেকে পাপপ্রবৃত্তি দূর হোক এমনটা চাই, আলোর পথ, জ্যোতির পথ, অমৃতের পথের সন্ধান চাই।
পবিত্র বেদমাতা বলছে বেদের জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে মুক্ত করুন—
স্তুতা ময়া বরদা বেদমাতা প্রচোদয়ন্তাং পাবমানী দ্বিজানাম্।
আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্তিং দ্রবিণং ব্রহ্ম বৰ্চসম্॥
মহ্যং দত্ত্বা ব্ৰজত ব্রহ্মলোকম্।
(অথর্ববেদ, ১৯/৭১/১)
শব্দার্থঃ— পরমাত্মা উপদেশ দিচ্ছেন হে মনুষ্য! (বরদা) বরদান প্রদানকারী (বেদমাতা) বেদমাতা (ময়া স্তুতা) আমার দ্বারা উপদেশ প্রদান করেছে। এই বেদবাণী (প্রচোদয়ান্তাম্, দ্বিজনাম্) চেষ্টাশীল দ্বিজগণকে, মনুষ্যগণকে (পাবমানী) পবিত্রকারী। এই বেদমাতা (আয়ুঃ) দীর্ঘায়ু (প্রাণম্) জীবনশক্তি (প্রজাম্) সুসন্তান (পশুম্) পশুধন (কীর্তিম) যশ (দ্রবিণং) ধন-ধান্য এবং (ব্রহ্ম বর্চসম্) ব্রহ্মতেজ প্রদানকারী। বেদের স্বাধ্যায় দ্বারা প্রাপ্ত এই পদার্থসমূহকে (মহাং, দত্ত্বা) আমাকে অর্পন করে (ব্রহ্মলোকং) মোক্ষকে (ব্রজৎ) প্রাপ্ত করো।
শব্দার্থ ও ভাবার্থ— (প্রচোদয়ন্তাম্) প্রেরণা দাত্রী (দ্বিজানাং পাবমানী) দ্বিজদের পবিত্রকারিণী (বরদা বেদমাতা) শ্রেষ্ঠ জ্ঞানদাত্রী বেদ মাতাকে (ময়াস্তুতা) আমি স্তুতি করিয়াছি (আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্তিং দ্রবিণং ব্রহ্ম বর্চসম্) আয়ুঃ প্রাণ, প্রজা, পশু, কীর্তি, ব্রহ্ম তেজ (মহাং দত্ত্বা) আমাকে দিয়া (ব্রহ্মলোকং-ব্রজৎ) মুক্তি লাভ করো।
অনুবাদঃ— বেদমাতা ভক্তের উক্তি-মনের উৎসাহ দাত্রী সবার মনের প্রেরণা দাত্রী, দ্বিজদের পবিত্রকারিণী, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান দাত্রী বেদমাতাকে আমি অধ্যয়ন করিয়াছি। শ্রীভগবানের উক্তি-আয়ু, প্রাণ, প্রজা, পশু, কীর্তি, ব্রহ্মতেজ আমাতে অর্পণ করিয়া তুমি মুক্তি প্রাপ্ত হও। (অথর্ববেদ, ১৯/৭১/১)
(অথর্ববেদ, ১৯/৭১/১ এর বিশ্লেষণ)
পরমাত্মা উপদেশ দিচ্ছেন হে মনুষ্য! আমি তোমাদের কল্যাণের জন্য বেদের উপদেশ প্রদান করেছি। এই বেদবাণী কর্মশীল মনুষ্যদেরকে পবিত্রকারী। যে মনুষ্য বেদের অধ্যয়ন করে এবং তদানুসারে আচরণ করবে তাঁর জীবন পবিত্র, নির্দোষ এবং নিষ্পাপ তো হবেই সাথে তাঁর –
• দীর্ঘায়ুর প্রাপ্তি হবে।
• জীবনশক্তি প্রাপ্ত হবে।
• সুসন্তানের প্রাপ্তি হবে।
• পশুর কমতি হবে না।
• চতুর্দিকে তাঁর কীর্তি বৃদ্ধি পাবে।
ধন-ধান্য, ঐশ্বর্য এবং বৈভবের নূন্যতা থাকবে না। বেদাধ্যয়ন দ্বারা প্রাপ্ত এই সকল বস্তুসমূহ নিজ স্বার্থের জন্য ভোগ করো না। এই সকল বস্তু সমূহকে প্রভুকে অর্পন করো, প্রজার হিতে লাগাও, মানব কল্যাণে লাগাও তবেই তোমার জীবনের চরম লক্ষ্য মোক্ষের প্রাপ্তি হয়ে যাবে।
সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের বেদের জ্ঞান দ্বারা সবার জীবন পবিত্রতা, আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার মাধ্যমে জগৎ-সংসার সুন্দর হোক এবং সবার মোক্ষের প্রাপ্তি হোক।
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম;
হর হর মহাদেব।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার