সনাতন ধর্মে দূর্বা ঘাস অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। সনাতন ধর্মে এই দূর্বা ঘাসকে পবিত্রতা, উর্বরতা এবং নবায়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দূর্বা ঘাস ঐশ্বরিক শক্তিকে আকর্ষণ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। দূর্বা ঘাস নিবেদন জীবনের বাধা ও অসুবিধা দূর করতে সাহায্য করে। দূর্বা ঘাস নিবেদন স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং সমৃদ্ধির আশীর্বাদ নিয়ে আসে। দূর্বা ঘাস নিবেদন করলে পরিবারের সামগ্রিক মঙ্গল বৃদ্ধি পায়। দূর্বা ঘাস নিবেদন করলে আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
সনাতন ধর্মে দূর্বা ঘাস এই উদ্ভিদের গুরুত্ব—
পথে-ঘাটে আপনা-আপনি কোনো আয়োজন ছাড়াই জন্মালেও দুর্বা ঘাসের রয়েছে আলাদা অনেক গুরুত্ব। ভেষজগুণসম্পন্ন ঔষধি উদ্ভিদটি মানবদেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে বড় অবদান রাখতে পারে। একই সঙ্গে এটির রয়েছে ধর্মীয় গুরত্বও। অনাদরের এই উদ্ভিদের গুরুত্বের কয়েকটি কারণ জানা যাক।
সাধারণত, পতিত জমিসহ যেকোনো খালি জায়গায় দূর্বা ঘাস জন্মায়। এটির প্রতিটির নিচে গুচ্ছমূল থাকে। ওপরে সবুজ পাতাযুক্ত একগুচ্ছ শাখা বের হয়। পাতা সরু, লম্বা, সবুজ ও মসৃণ এবং দুই সারিতে সজ্জিত।
দূর্বা ঘাসের পরিচিতি পাওয়া যায়—
প্রচলিত নাম হলো দূর্বা ঘাস। ইউনানী নাম বলা হয়েছে দূর্বা বা দুব আয়ুর্বেদিক নাম বলা হয় দুব। ইংরেজীতে বলা হয় Bermuda grass, Dove grass. বৈজ্ঞানিক নাম বলা হয় Cynodon dactylon Pers. পরিবার থেকে বলা হয়েছে Poaceae (Gramineae).
দূর্বা ঘাসে যে সমস্ত রাসায়নিক উপাদান আছে—
টারপিনয়েড যৌগ যেমন অরুনডেইন, লুপিনোন ইত্যাদি বিদ্যমান। এছাড়া দুর্বা ঘাসে প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ও বেশ কিছু অর্গানিক এসিড পাওয়া যায়। এতে রয়েছে বহু পুষ্টিগুণ। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশ, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, প্রোটিন, এনজাইম, শর্করা, আঁশ, ফ্লাভোনয়েডস রয়েছে এই ঘাসে। দূর্বা ঘাস একটি আগাছা মূলত আপদ হিসেবেই বিবেচিত। অবাঞ্চিত হলেও এই আগাছার রয়েছে মূল্যবান ঔষধিগুণ। এটি মানবদেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সুপ্রিয় পাঠক, আসুন তাহলে জেনে নিই আমাদের আশেপাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা এই আগাছার ওষুধি গুণ। রক্তক্ষরণ, কেটে যাওয়া বা আঘাতজনিত রক্তপাত, চুল পড়া, চর্মরোগ, দন্তরোগ ও আমাশয়ে উপকারী।
১) দূর্বা ঘাসের রস দিয়ে চুল ওঠা বন্ধ হয়। একটি পাত্রে এক লিটার নারিকেল তেল মৃদু তাপে জ্বাল করে ফেনা ফেলে নিন। তারপর দূর্বার ঘাসের টাটকা রস ২০০ মিলি সম্পূর্ণ তেলে মিশিয়ে ফের জ্বাল দিন। চুলা থেকে নামিয়ে ছেঁকে সংরক্ষণ করুন। গোসলের ১ ঘণ্টা আগে ওই তেল চুলে মাখুন। নিয়মিত ২ থেকে ৩ মাস ব্যবহার করলে চুল পড়া বন্ধ হবে।
২) শরীরের কোন স্থান কেটে গেলে দূর্বা ঘাস পিষে আক্রান্ত স্থানে প্রলেপ দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায় এ ক্ষেত্রে দূর্বার শিকড় ব্যবহার করলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা অর্চনায় দূর্বা প্রয়োজন হয়। গ্রামীণ বিয়ের অনুষ্ঠানেও এক অনন্য অনুষঙ্গ দূর্বা ঘাস।
৩) নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করতে দূর্বার রস ব্যবহার করা যায়। এবং বমি বমি ভাব বন্ধের জন্য দূর্বা ঘাসের রস ২ থেকে ৩ চামচ ১ চা চামচ চিনির সঙ্গে মিশিয়ে ১ ঘণ্টা পর পর খাবেন। বমি ভাব কেটে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দিন।
৪) নারীদের ঋতুচক্র দীর্ঘ ও অতিরিক্ত স্রাব এবং জরায়ুর স্থানচ্যুতিতে দূর্বাঘাস কার্যকরী। এই ক্ষেত্রে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা, দূর্বা ঘাসের রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে দিনে তিন থেকে চার বার পান করার পরামর্শ দেওয়া যায়। আয়ুর্বেদীয় মতে রক্ত পিত্তে দূর্বা ঘাস মহৌষধ। এ’রোগে মুখ, নাক ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রক্তস্রাব হতে পারে। এ’ক্ষেত্রে দুর্বা ঘাসের রসের সাথে কাঁচা দুধ মিশিয়ে খাইলে রোগের উপশম হয়।
৫) শ্বেতপ্রদরজনিত দূর্বলতায় দূর্বা ঘাস ও কাঁচা হলুদের রস সমপরিমাণে মিশিয়ে খেলে রোগী দূর্বলতা কাটিয়ে ওঠে এবং শরীরের ক্ষতস্থানে দূর্বা ঘাস পেস্ট বানিয়ে লাগালে এটি উপকারী হিসেবে ফল দেয়।
৬) দূর্বা ঘাস সন্তান ধারণের ক্ষেত্রেও সম্ভাবনাময় ওষুধ। গর্ভধারণে অসমর্থ হলে দূর্বা ও আতপ চাল এক সাথে বেটে বড়া করে ভাতের সাথে সপ্তাহে তিন, চারদিন খেলে উপকার পাওয়া যায়।
৭) দূর্বা ঘাস শরীরের রেচনতন্ত্রের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং প্রস্রাবে কষ্ট হয় অথচ পাথুরী রোগ হয়নি এ’রকম ক্ষেত্রে দূর্বার রস দুধ ও পানি মিশিয়ে খেলে ভাল ফল দেয়। তবে অর্শরোগ থাকলে এটা খাওয়া যাবে না।
৮) দীর্ঘস্থায়ী আমাশয় রোগেও দূর্বা ঘাসের রয়েছে ফলদায়ক ভূমিকা। এ’ ক্ষেত্রে দূর্বা ঘাসের রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
৯) এছাড়াও অস্বাভাবিক যোনি স্রাব, মূত্রনালীর সংক্রমণ, প্রসূতিদের বুকের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের (পিসিওএস) জন্যও দূর্বা ঘাস উপকারী।
১০) প্রাচীন চিকিৎসা মতে, চোখের জ্বালাপোড়া ও কন্জাঙ্কটিভাইটিস বা চোখ ওঠা সেরে ওঠার জন্য দূর্বা ঘাস জ্বাল দিয়ে পানি ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন চিকিৎসকরা।
সনাতন ধর্মে দূর্বা পবিত্রতার প্রতীক, দূর্বা পুনর্জীবন, দীর্ঘ জীবন, ও উন্নতির ও প্রতীক। তার কারণ হলো দূর্বার একটি ঘাস তুলে নিলেও তার জায়গায় আবার গজিয়ে উঠে নুতুন দূর্বা। দূর্বার সংস্পর্শে যা আসে তাই পবিত্র হয়ে উঠে বলে বিশ্বাস। দূর্বা সকল অশুভ শক্তিকে শোষণ করে শুভ শক্তির বিকিরণ করে তাই সকল পূজায় দূর্বার ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। দূর্বাকে পবিত্র মানার আরেকটি কারণ হলো বলা হয় দূর্বার গোঁড়ায় থাকেন স্বয়ং ব্রহ্মা, মধ্যে বিষ্ণু আর অগ্রভাগে মহেশ্বর। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীকে দূর্বা অষ্টমী হিসেবে পালন করা হয়। ঐ দিন দূর্বার অগ্রভাগ পূর্ব মুখী করে ভগবান কে দূর্বা উৎসর্গ করা হয় এই বিশ্বাসে যে এই অনুষ্ঠানের দ্বারা পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
পবিত্র বেদে বলা হয়েছে দূর্বা ঘাসের ন্যায় স্বীয় কুলকে বৃদ্ধিকারী হোক। পবিত্র বেদ দূর্বার তত্ত্ব পাওয়া যায়—
বল্মীকমূর্ধনি যদা দূর্বা চ কুশাশ্চ পাণ্ডুরাঃ সন্তি।
(বৃহত্সংহিতা – অধ্যায, ৫৩/৭৭)
ভূমিঃ কদংবকযুতা (ভূমী কদংবকযুতা, ভূমীকদংবকযুতা) বল্মীকে যত্র দৃশ্যতে দূর্বা।
(বৃহত্সংহিতা – অধ্যায ৫৩/৭৮)
(বেদ বোধা অন্তরাধাম - দূর্বা সুক্তম ২৩) অনেক গুলো মন্ত্রে দূর্বার মন্ত্র রয়েছে।
হে অগ্নি! তুমি যাহাকে দাহ করিলে, পুনৰ্ব্বার তাহাকে নির্বাপিত কর। কিঞ্চং জল এই স্থানে উপস্থিত হউক এবং শাখাপ্রশাখাযুক্ত পরিণত দূর্বা এই স্থানে উৎপন্ন হউক।
(ঋগ্বেদ সংহিতা, ১০ম মণ্ডল/ সূক্ত ১৬/ মন্ত্র ১৩) অগ্নি দেবতা, দমন ঋষি।)
কাণ্ডাৎ কাণ্ডাৎ প্রবোহন্তী পরুষঃ পরুষম্পরি।
এবা নো দূর্বে প্রতনু সহস্রেণশতেন চ॥
(যজুর্বেদ, ১৩/২০)
অনুবাদ— (স্বয়মাতৃগ্না ইষ্টকের উপরে কিছু দূর্বা ধারণীয়) –হে দূর্বা! এই প্রস্তরনির্মিত পাত্রের (পাথরের বাটির) প্রত্যেক ভাগে ও পর্বে পর্বে বা স্বয়ং প্রত্যেক কাণ্ডে ও পর্বে পর্বে অঙ্কুরিত হয়ে যে রকম তুমি স্বয়ং বিস্তারকে সম্প্রপ্ত হয়ে থাকে, সেই রকম আমাদেরও হে দূর্বা! শত-সহস্র পুত্র-পৌত্রে অভিবৃদ্ধ করো।
যাশতেন প্রতনোষি সহস্রেণ বিবোহসি।
তস্যান্তে দেৰীষ্টকে বিধেম হবিষা বয়ম্৷৷
(যজুর্বেদ, ১৩/২১)
অনুবাদ— হে দেবী দূর্বা (ইষ্টকা)! যে তুমি স্বয়ং নিজেকে শত-শত কাণ্ডে বিস্তার করো এবং তার পর আপন সহস্র-সহস্র অঙ্কুরের সাথে পৃথিবী ভেদ করে বাহির হও; সেই তুমি সদূর্বা ইষ্টকাকে এই স্থানের হবিঃতে আমরা পরিচরিত করছি৷
দূর্বা সূক্তম (মহানারায়ণ উপনিষদ) এ পাওয়া যায়—
সহস্রপরমা দেবী শতমূলা শতাঙ্কুরা।
সর্বঁহরতু মে পাপং দূর্বা দুঃস্বপ্ননাশিনী।। (৩৪)
কাণ্ডাত্ কাণ্ডাত্ প্ররোহন্তী পরুষঃ পরুষঃ পরি।
এবা নো দূর্বে প্রতনু সহস্রেণ শতেন চ।। (৩৫)
যা শতেন প্রতনোষি সহস্রেণ বিরোহসি।
তস্যাস্তে দেবীষ্টকে বিধেম হবিষা বযম্।। (৩৬)
অশ্বক্রান্তে রথক্রান্তে বিষ্ণুক্রান্তে বসুন্ধরা।
শিরসা ধারযিষ্যামি রক্ষস্ব মাং পদে পদে।। (৩৭)
दुर्वा सूक्तम् (महानारायण उपनिषद्)
स॒ह॒स्र॒पर॑मा दे॒वी॒ श॒तमू॑ला श॒ताङ्कु॑रा । सर्वग्ं॑ हरतु॑ मे पा॒प॒-न्दू॒र्वा दुः॑स्वप्न॒ नाश॑नी । काण्डा᳚-त्काण्डा-त्प्र॒रोह॑न्ती॒ परु॑षः परुषः॒ परि॑ ।
ए॒वा नो॑ दूर्वे॒ प्रत॑नु स॒हस्रे॑ण श॒तेन॑ च । या श॒तेन॑ प्रत॒नोषि॑ स॒हस्रे॑ण वि॒रोह॑सि । तस्या᳚स्ते देवीष्टके वि॒धेम॑ ह॒विषा॑ व॒यम् । अश्व॑क्रा॒न्ते र॑थक्रा॒न्ते॒ वि॒ष्णुक्रा᳚न्ते व॒सुन्ध॑रा । शिरसा॑ धार॑यिष्या॒मि॒ र॒क्ष॒स्व मा᳚-म्पदे॒ पदे ॥ 1.37 (तै. अर. 6.1.8)
দুর্বা সূক্তম (মহানারায়ণ উপনিষদ) অনুবাদ—
সহস্র দেবতার প্রভু, সকল প্রাণীর মধ্যে থাকা অশুভ, অশুভ এবং দুঃস্বপ্ন ধ্বংস হোক। কান্দা-তকান্দা-তপ্রোহন্তি একজন পুরুষ, একজন পুরুষ, একজন মহিলা।
অথবা এমন একজন ব্যক্তি যিনি বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকেন, যিনি সর্বদা খুশি থাকেন। এই অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। অতএব, দেবীই হলেন সকল দুঃখের কারণ। সারথি, মাথা হলো শরীরের সুরক্ষার স্থান। ১/৩৭ (তৈ. অর, ৬/১/৮)
পুরানে এক উপাখ্যানে এর ব্যাখা পাওয়া যায়—
পৌরাণিক ব্যাখ্যামতে কথিত রয়েছে বৃত্রাসুর নামে এক শক্তিশালী রাক্ষস দেবতাদের ভয় দেখাত। ইন্দ্রের শক্তিশালী অস্ত্র বজ্রযুধ (গদা) দিয়ে আঘাত করেও তাকে পরাজিত করা যাচ্ছিল না। তাকে আঘাত করতে গেলেই সে পানির একটি সুরক্ষা বাঁধ তৈরি করে নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছিল। তখন ব্রহ্মা ইন্দ্রের গদা একটি জলাশয়ে ভিজিয়ে আবার তাকে দিলে এবার ওই রাক্ষস পরাজিত হন। মূলত ব্রহ্মা ওই জলাশয়কে একটি দর্ভ (দুর্বা) ঘাসে রূপান্তরিত করেছিলেন। ব্রহ্মা ঘাসের মাধ্যমে ইন্দ্রের গদাকে বিশুদ্ধ করার পরই তিনি সফল হন। সেখান থেকেই বিভিন্ন ঐতিহ্য জুড়ে বিশুদ্ধ আচারের তাৎপর্য তুলে ধরে এই ঘাস।
হিন্দুদের দেব দেবীদের পূজায় এই দূর্বা ঘাসের প্রয়োজন হয় কেন?
দূর্বার মাহাত্ম্য— দূর্বা আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা বা যে কোন শুভ কাজের এক অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু কেন দূর্বা ব্যাবহার করা হয় তা অনেকেই জানি না। আজ আমরা তাই নিয়ে একটু আলোচনা করবো।
দূর্বার উল্লেখ আমরা ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদে পাই। ভবিষ্য পুরাণে বর্ণিত আছে যে দূর্বার জন্ম হয় ভগবান বিষ্ণুর হাত ও উরুর লোম থেকে যখন তিনি সমুদ্র মন্থনে মন্ত্র পর্বতকে সাহায্য করছিলেন। আবার বামন পুরাণে উল্লেখ যে দূর্বার জন্ম হয় নাগ বাসুকীর পুচ্ছ থেকে যে সময় দেব-আসুরেরা মিলিত ভাবে সমুদ্র মন্থন করছিলেন। আবার আরেক পুরাণের কাহিনী অনুসারে দুর্বাসুর নামে এক কৃষ্ণ ভক্ত অসুর ছিলেন। দুর্বাসুরের মা কৃষ্ণ বিদ্বেষী ছিলেন। দুর্বাসুরের বাবা, ভাই দেবতার হাতে মারা যান। তাই মা দেবতার স্বর্গ রাজ্য ধ্বংস ও দেবতার মৃত্যু চাইতেন। মা দুর্বাসুরকে ত্রিদেবের তপস্যা করে (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব) অমর হয়ে ত্রিলোক জয় করতে আদেশ দিলেন। মা ত্রিলোকের রাজমাতা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল।
মায়ের কথায় দুর্বাসুর নির্জনে কঠোর তপস্যা শুরু করে। হাজার বছর তপস্যার ফলে তার শরীরের মাংস পচে খসে পড়ে। উইপোকা ও পোকামাকড়ে খেয়ে হাড়ও খসে মাটিতে মিশে গেছে। তখনও ত্রিদেবের নামে ধ্যান হচ্ছে। দেবতারা ভয় পেয়ে দুর্বাসুরের তপস্যা ভঙ্গে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ত্রিদেব দুর্বাসুরের কাছে এসে ব্রহ্মা কমন্ডুলের জল ছিটিয়ে পূর্বরূপ দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। দুর্বাসুর বললেন প্রভু আমি মাতৃ আজ্ঞাতে তপস্যা করেছি। মা অমরত্ব বর নিতে বলেছেন। হে গোবিন্দ আমাকে অমরত্ব বর দিলে মা আবারো খারাপ কাজ করাবে। তাই এমন বর দিন যাতে আমি অমরও হতে পারি আবার আপনার সেবায়ও লাগতে পারি। আর আমার দ্বারা যেন জগতের কারো অনিষ্ট না হয়।
ত্রিদেব সন্তুষ্ট হয়ে বললেন শুধু ত্রিদেব নয় জগতের সব দেবতার সেবায় লাগবে তুমি। দুর্বাসুর তুমি দূর্বা ঘাসে পরিণত হয়ে সব দেবতার পূজায় লাগবে। অক্ষয় তৃতীয়ায় অক্ষয় বরে জগতে সবাই মারা গেলেও দুর্বা ঘাস কখনো মরবে না। অমর থাকবে পৃথিবীতে। পূজাতে দুর্বা পাতা লাগে তিনটি। তিনটি পাতায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব অবস্থান করেন। জগতে কোন শুভ কাজ ত্রিদেবকে ছাড়া সম্ভব নয়। তাই শুভকাজে দূর্বা ছাড়া আশীর্বাদ হবে না। সেই থেকেই দেবদেবীর পূজায় দূর্বার প্রয়োজন হয়। দূর্বা পবিত্রতার প্রতীক, দূর্বা পুনর্জীবন, দীর্ঘ জীবন, ও উন্নতির ও প্রতীক। তার কারণ হলো দুর্বার একটি ঘাস তুলে নিলেও তার জায়গায় আবার গজিয়ে উঠে নুতুন দূর্বা। দূর্বার সংস্পর্শে যা আসে তাই পবিত্র হয়ে উঠে বলে বিশ্বাস। দূর্বা সকল অশুভ শক্তিকে শোষণ করে শুভ শক্তির বিকিরণ করে তাই সকল পূজায় দূর্বার ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। দুর্বাকে পবিত্র মানার আরেকটি কারণ হলো বলা হয় দূর্বার গোঁড়ায় থাকেন স্বয়ং ব্রহ্মা, মধ্যে বিষ্ণু আর অগ্রভাগে মহেশ্বর। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টমীকে দূর্বা অষ্টমী হিসেবে পালন করা হয়। ঐ দিন দুর্বার অগ্রভাগ পূর্ব মুখী করে ভগবান কে দূর্বা উৎসর্গ করা হয় এই বিশ্বাসে যে এই অনুষ্ঠানের দ্বারা পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
সনাতন ধর্মে সকল দেব-দেবীদের পূজায় দূর্বা নিবেদন করা হয়—
সনাতন ধর্মে দূর্বা এটি ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং অন্যান্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। দূর্বা ঘাস নিবেদন করলে ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়। দূর্বা ঘাস নিবেদনের সাথে সম্পর্কিত বিস্তারিত দূর্বা ঘাস কীভাবে নিবেদন করবেন— দূর্বা ঘাস বিজোড় সংখ্যায় নিবেদন করা হয় এটা সর্বদা শুভ বলে বিবেচিত হয়। দূর্বা ঘাসের পূজার মধ্যে নিবেদন করার সংখ্যা ৩, ৫, ৭ অথবা ২১ হওয়া উচিত।
আপনারা হয়তো দেখেছেন গনেশকে দূর্বা দান করতে। কথিত আছে গনেশকে ২১ গাছি দূর্বা দিয়ে প্রার্থনা করলে গণেশ ঠাকুর প্রসন্ন হন। রামেশ্বরমের মন্দিরে দেখেছি দূর্বা দিয়ে গণেশ কে আপাদমস্তক আবৃত করে দেওয়া হয়। এর পিছনে যা কাহিনী আছে তা সংক্ষেপে আপনাদের বলছি। একসময় অনলাসুর নামে এক মহা প্রতাপবান ও অত্যাচারী অসুর ছিল, জানা যায় অনলাসুর যমরাজ ও অপ্সরা তিলত্তোমার ছেলে ছিল। সেই অনলাসুর একবার তপস্যার দ্বারা দেবাদিদেব মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে বর লাভ করেছিল। বর হিসেবে তাঁর চোখ থেকে আগুনের গোলা বের করার ক্ষমতা লাভ করে এবং সেই থেকে তাঁর নাম হয় অনলাসুর। অনল মানে আগুন। এই মহাশক্তির বলীয়ান হয়ে অনলাসুর প্রবল অত্যাচারি হয়ে উঠে। নির্দয় ভাবে সে সকলকে হত্যা করতে শুরু করে। সাধু-সন্ন্যাসীদের যাগযজ্ঞ নষ্ট করে নির্বিচারে লুন্ঠন হত্যা করতে থাকে। এমনকি তাঁর হাত থেকে দেবতারাও নিস্তার পেলেন না। অনলাসুরের ভয়ে তাঁরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। অনলাসুর তাঁর চোখ থেকে আগুন গোলা দিয়ে চারিদিক ধংশ করতে থাকে, স্বর্গ মর্ত্ত পাতালে শুরু হয়ে যায় হাহাকার।
অনলাসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের তাড়িয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ইন্দ্র সেখান থেকে পালিয়ে যান। ইন্দ্রের পলায়নের পর অনলাসুর স্বর্গ রাজ্যে অধিকার করে বসে। অনলাসুরের ভয়ে ভীত হয়ে অত্যাচারিত দেবতারা দেবগুরু বৃহস্পতির নির্দেশে ভগবান গনেশের শরনাপন্ন হয়ে গণেশ কে অনলাসুর থেকে স্বর্গ কে উদ্ধার ও দেবগন কে রক্ষা করার প্রার্থনা জানান। দেবতাদের কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভগবান গণেশ তাঁদের কে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। গণেশ জানতেন যে অনলাসুর প্রচন্ড পরাক্রমী তাই তিনি অনলাসুর কে বধ করার জন্যে কৌশল অবলম্বন করলেন। গণেশ নিজেকে একটি ছোট্ট শিশুতে পরিনত করে অনলাসুরের সাথে যুদ্ধ শুরু করলেন। অনলাসুরের চোখ থেকে নির্গত আগুনের গোলা গুলিদের তিনি কৌশলে এড়িয়ে যেতে থাকলেন কিন্তু সেই ভয়ানক আগুনের গোলা গুলি চারিদিক ধ্বংস করতে শুরু করলো। অনেকক্ষন যুদ্ধের পর অনলাসুর যখন শিশুরূপী গণেশ কে গ্রাস করতে উদ্যত হল। গণেশ তখন তাঁর বিরাট-রূপ ধারন করে অনলাসুর কে গিলে ফেলেন।
এদিকে অনলাসুর কে গিলে ফেলায় গণেশের শরীরের ভিতর সৃষ্টি হয় প্রচন্ড যন্ত্রণার। সেই যন্ত্রণায় তিনি হটফট করতে থাকেন, তাঁর এই অবস্থা দেখে স্বর্গের সকল দেবতারা মিলে গণেশের যন্ত্রণা দূর করার চেস্টা করতে থাকেন। দেবী পার্বতী গণেশের সর্বাঙ্গে চন্দনের প্রলেপ দিলেন, কিন্তু সেই আগুনের জ্বালার কোন প্রশমন হল না। দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর গলার সাপ দিয়ে গণেশের কোমর বেঁধে দিলেন, কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলো না। আগুনের সেই ভীষণ যন্ত্রণায় গণেশ ছটফট করতে থাকেন। ভগবান বিষ্ণু তখন প্রচুর পরিমানে পদ্মের জল ছিটিয়ে দিলেন গণেশের গায়ে, সেই থেকে গণেশের এক নাম হয় পদ্মপাণি। তাতেও কোন লাভ হলো না। চন্দ্রদেব তাই দেখে গণেশের মাথার উপর অবস্থিত হয়ে শীতলতা প্রদান করতে শুরু করলেন সেই জন্য গণেশের আরেক নাম হয় ভালচন্দ্র। সকল প্রচেষ্টা বিফল হতে দেখে মহামুনি কাশ্যপ ২১টি দূর্বা গণেশের মাথায় নিবেদন করেন এবং সেই দূর্বা গুলিই গণেশের যন্ত্রণার অবসান ঘটালো, সেই দূর্বা গুলি দ্বারাই গণেশের শান্তি ফিরে এলো। এতে সন্তুষ্ট হয়ে গণেশ ঘোষণা করলেন যে দূর্বাই হবে উনার সবচাইতে প্রিয় আর যেই ভক্ত শ্রদ্ধা সহকারে ২১ টি দূর্বা গণেশকে নিবেদন করবে তাঁর জীবন ধনধান্যে পরিপূর্ণ হবে ও তাঁর জীবনে নেমে আসবে সুখ। পৃথিবীর সকল প্রকার জ্বালা যন্ত্রণা থেকে তাঁর জীবন হবে মুক্ত। আবার এই ২১ টি দূর্বার মাহাত্ম্য হিসেবে বর্ণিত আছে যে এই ২১টি দূর্বা কিন্তু প্রতীকী। এই ২১ টি দূর্বা হচ্ছে আমাদের মধ্যে পঞ্চ ভুত, পঞ্চ প্রাণ, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, ও মন এই সকলের প্রতীক।
সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের আশীর্বাদ হল অনুগ্রহ, পবিত্রতা, আধ্যাত্মিক মুক্তি, অথবা ঐশ্বরিক ইচ্ছার মাধ্যমে জগৎ-সংসার সুন্দর হোক, সবার জীবনে সবকিছু কিছু প্রদান হোক।
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম;
হর হর মহাদেব।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার