শুচি ও অশুচি মানে— পবিত্র ও অপবিত্র।
ॐ অশুচি হোক বা শুচি হোক বা সর্বাবস্থায়।
শুদ্ধি মন্ত্র -
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতঃ অপি বা
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং সবাহ্যং অভ্যন্তর শুচি।।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং সবাহ্যং অভ্যন্তর শুচি।।
ওঁ শুচিঃ ওঁ শুচিঃ ওঁ শুচিঃ
পবিত্র বা অপবিত্র যে কোন অবস্থাতেই শ্রীবিষ্ণুর নাম স্মরণ করলে তাঁর বাহির ও ভেতর পবিত্র হয়ে যায়। সে বিষ্ণুকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম। (বিষ্ণুর আরেক নাম— পুণ্ডরীক)।
হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে, 'স্নান' একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আধ্যাত্মিক নিয়ম অনুযায়ী করা হলেই তা ফলপ্রসূ হয়।
মন্দিরে আমরা কী দেখতে পাই? সেখানে আমরা দেব-দেবী, প্রার্থনা-উপাসনা, পূজা-অৰ্চনা এগুলো দেখি। মন্দিরের পরিবেশটা একটু অন্যরকম মনে করি।
এক্ষেত্রে প্রথমেই আসে শুচিতার কথা। কোনো মন্দিরে যাওয়ার সময় প্রথমেই আমাদের মন এবং শরীরকে পরিষ্কার ও পবিত্র করে যেতে হয় যাকে আমরা শুচিতা বলে থাকি। এবার আমরা ধর্মীয় আলোকে শুচিতা কী তা জানব—
শুচিতা মানে নির্মলতা, পবিত্রতা। এই পবিত্রতার শুরু হয় মন থেকে। মনে শুচিতা থাকলে আমরা খারাপ চিন্তা থেকে বিরত থাকি, কারও ক্ষতি করতে চাই না, কারও অশুভও কামনা করি না। মনে শুচিতা থাকলে আমরা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
শুচিতা মানে যেমন মনের পবিত্রতা, তেমন শরীরের পবিত্রতাও। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক, পরিবেশ, প্রকৃতি দেখলে অন্যের মনেও পবিত্রতার অনুভূতি আসে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাটা ঈশ্বর পছন্দ করেন। শুচিতা ধর্মের অঙ্গ। শুচিতার মাধ্যমে শরীর ও মনের পবিত্রতা আনা যায়। শরীর ও মনকে সাধনার উপযোগী করার জন্য শুচিতা প্রয়োজন। শুচিতা প্রধানত দুই প্রকার, যথা: অভ্যন্তরীণ শুচিতা ও বাহ্যিক শুচিতা।
অভ্যন্তরীণ শুচিতা :
অভ্যন্তরীণ শুচিতা বলতে মনের অন্তরের শুচিতাকে বোঝায়। বিদ্যার্জন, সদাচরণ প্রভৃতির মাধ্যমে মনের বা অন্তরের শুচিতা অর্জন করা যায়। পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা, সবার জন্য সুচিন্তা করা, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে কথা না বলা এগুলো সবই ভালো মনের পরিচয় বা অভ্যন্তরিণ - শুচিতার প্রতিফলন।
বাহ্যিক সুচিতা বাহ্যিক শুচিতা বলতে শারীরিক শুচিতা বোঝায়। জল দিয়ে বাহ্যিকভাবে শুচি হওয়া যায়। আমরা প্রতিদিন হাত-মুখ ধুই, স্নান করি। এভাবে বাহ্যিক শুচিতা অর্জন করি। এছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার করার মাধ্যমেও বাহ্যিক শুচিতা অর্জন করা যায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: শুচিতার ন্যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও ধর্মের অঙ্গ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বলতে সুন্দর ও পরিপাটি অবস্থাকে বোঝায়। উপাসনা, প্রার্থনা, পূজা-পার্বনের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হয়। কারণ ধর্মীয় কাজের ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন সবার আগে। অপরিষ্কার অবস্থায় ধর্মীয় কাজে মন বসে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে এমন আরও অনেক কিছু আছে। যেমন, নিজের কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রাখা, বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র পরিপাটি করে রাখা, আশপাশের পরিবেশ সুন্দর রাখা। বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর রাখা ইত্যাদি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যক্তিগত হতে পারে আবার সর্বজনীনও হতে পারে।
নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হয়। নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়। এগুলো ব্যক্তিগত পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা। বিদ্যালয়, মন্দির, ধর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। বাড়ির আধিনা, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। সবার অংশগ্রহণে এই পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়। এটাই সর্বজনীন পরিচ্ছন্নতা।
শুচিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব :
শুচিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ধর্মচর্চার পূর্বশর্ত। শুচিতা প্রার্থনার অপরিহার্য অংশ। শুচিতা ও পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতায় শরীর ও মন সুস্থ থাকে। আর শরীর ও মন সুস্থ থাকলে ধর্ম-কর্ম ভালো হয়।
পবিত্রতা এমন কিছু বর্ণনা করে যা কোনও দেবতার সেবা বা উপাসনার জন্য উৎসর্গীকৃত বা আলাদা পৃথক করা হয়; যা আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধা ভক্তি বা নিষ্ঠার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হয়; অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে বিস্ময় বা নিষ্ঠা ও সশ্রদ্ধ অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে। এটি প্রায়শই "ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ বস্তু" (পবিত্র নিদর্শন যা গভীর শ্রদ্ধাভক্তি ও আশীর্বাদ প্রাপ্ত) বা "পবিত্র স্থান" এর জন্য আরোপিত করা হয়।
কী কী কারণে মানুষ অপবিত্র হয় এবং কিভাবে সব সময় পবিত্র থাকা যায়?
অন্যের ভালো দেখে মনে যদি খুব আনন্দ হয়, অন্যের দুঃখ দেখে যদি মনটা কেঁদে উঠে, অন্যকে কোনোভাবে আহত করার ইচ্ছে যদি কখনোই মনে না জাগে তাহলে পবিত্র থাকা যাবে। নিজের মনের এই অবস্থাই, পবিত্রতা।
যে মনে কুচিন্তা, অন্যের অকল্যাণ চিন্তা, অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, এসব নিয়ে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে একশো আট বার ডুব দিয়ে, বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে বসে, কোটি কোটি বার মন্ত্র জপ করলেও, পবিত্রতা কোনোদিনই স্পর্শ ও করবে না।
অপবিত্র ভাবনা চিন্তা, কু-সঙ্গ করা, তামসিক আহার গ্রহণ করা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহঙ্কার, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, প্রত্যাশা, ইত্যাদি কারণেই মানুষের মধ্যে অপবিত্রতা আসে আর এগুলো বর্জন করলেই জীবন পবিত্র হয়ে ওঠে।
দেহ শুচিতার বিষয়ে বৈদিক হিন্দু ধর্ম কি বলা হয়েছে—
অনেকেই প্রায়শঃ বলে থাকেন সনাতন ধর্মের অনেক লোককেই বিশেষত পুরুষদের প্রস্রাব করার পর জল ব্যবহার করতে দেখা যায় না। তা কিছুটা সত্য আর এরূপ অশুচিতার জন্য অন্য ধর্মের লোকেরা হিন্দু সমাজকে নিন্দা করে থাকেন। অথচ সনাতন ধর্মে মলমূত্র ত্যাগের পর শুচিতার বিষয়ে কঠোর নির্দেশ আছে। সনাতন ধর্মের স্মৃতিশাস্ত্র মনুসংহিতার আলোকে আমি শুচিতা বিষয়ে নিবেদন করছি।
বসা (চর্বি), শুক্র, রক্ত, মজ্জা, মূত্র, বিষ্ঠা, নাসিকা মল, কানের মল, শ্লেষ্মা, অশ্র“, দূষিকা (চোখের মল) এবং ঘাম-এই বারোটি মানুষের শারীরিক মল (মনুসংহিতা, ৫/১৩৫)।
মলদ্বার ও প্রশ্রাবদ্বার শুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনমত মাটি ও জল ব্যবহার করা কর্তব্য। যে বারো রকমের মলের কথা বলা হয়েছে তা শুদ্ধ করতে গেলেও মাটি এবং জল প্রয়োগ করা উচিত (মনুসংহিতা, ৫/১৩৪)।
মল মূত্র ত্যাগ করার পর শুদ্ধি লাভ করার জন্য প্রশ্রাব দ্বারে একবার, মলদ্বারে তিনবার একটি হাতে অর্থাৎ বামহাতে দশবার এবং দুই হাতেই সাতবার জলের সাথে মাটি ঘষে দিতে হবে। (যদি একবার প্রক্ষালণেই দুর্গন্ধ চলে যায়, তাহলেও উক্ত সংখ্যা পূর্ণ করতে হবে) (মনুসংহিতা, ৫/১৩৬)।
উপরে যে শূচিতার বিধান দেওয়া হয়েছে তা কেবলমাত্র গৃহস্থদের পক্ষে প্রযোজ্য। ব্রহ্মচারীর পক্ষে দ্বিগুণ, বানপ্রস্থাশ্রমীর পক্ষে তিন গুণ এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে চার গুণ পরিমাণ আচরণীয় (মনুসংহিতা, ৫/১৩৭)।
মল ও মূত্র ত্যাগ করার পর এভাবে শৌচকাজ করে আচমন করার পর নাভির উর্ধ্বভাগের ইন্দ্রিয় ছিদ্রগুলোর জল দিয়ে স্পর্শ করবে। বেদ অধ্যয়নের আগে ও ভাত খাওয়ার পর সকল সময়েই এভাবে আচমন কর্তব্য (মনুসংহিতা, ৫/১৩৮)।
যে লোক অনেকবার বমি করেছে বা বিরেচন (ভেদ বা দাস্ত) করেছে, সে স্নান করে ঘি ভোজন করবে। যে লোক ঋতুমতী স্ত্রীর সাথে মৈথুন করেছে; সে স্নান করলেই শুদ্ধ হবে (মনুসংহিতা, ৫/১৪৪)।
দিবাভাগে উত্তর মুখ ও রাত্রিতে দক্ষিণ মুখ এবং দিবা রাত্রির সন্ধিক্ষণে উত্তর মুখে মল মূত্র ত্যাগ করতে হয়। তবে বেশি বেগ না হলে সন্ধি সময়ে (সন্ধ্যা ও খুব সকালে) মলমূত্র ত্যাগ নিষিদ্ধ। মলমূত্র ত্যাগ করে কাপড় ধৌত করা কর্তব্য। চন্দ্র, সূর্য, জল, বায়ু, গোও ব্রাহ্মণের অভিমুখে এবং পথ, ভস্ম, গো-স্থান, চষাভূমি, জলচিতা, শ্মশান, পর্বত, দেবমন্দির, উইভূমি, প্রাণিযুক্ত গর্ত এবং নদীর তীরে বসে মলমূত্র ত্যাগ নিষিদ্ধ। মলাদি ত্যাগ কালে কথা বলা, হাই বা হাঁচি দেয়া নিষিদ্ধ। গমন করতে করতে বা দাঁড়িয়ে, জুতা, খড়ম ধারণ করে এবং জলশৌচ পাত্র হাত দ্বারা ধরে রেখে মল ত্যাগ নিষিদ্ধ। ডান হাত দ্বারা শৌচাদি ক্রিয়া নিষিদ্ধ। দন্তধাবন (দাঁত মাজন) না করে কোন ক্রিয়াতেই অধিকার হয় না। কাজেই ব্রাহ্মমুহূর্তে শৌচ ক্রিয়ার পর দন্তধাবন অবশ্য কর্তব্য। জিহবা মাজনও কর্তব্য। ঘুম থেকে উঠে, হাঁচির পরে, ভোজন করে, শ্লেষ্মা ত্যাগ করে, মিথ্যা কথা বলে, জলপান করে এবং বেদাধ্যয়ন করতে প্রবৃত্ত হয়ে আগে থেকে শূচি থাকলেও আচমন করতে হবে। (জল দ্বারা দেহ শুদ্ধিকরণ- ওঁ শ্রী বিষ্ণু, ওঁ শ্রী বিষ্ণু, ওঁ শ্রী বিষ্ণু তিনবার পাঠ) (মনুসংহিতা, ৫/১৪৫)।
এতো গেল দেহশূচির কথা। প্রকৃতপক্ষে, শৌচবিধি দু’প্রকার- বাহ্য ও অভ্যন্তর। জল ও মাটি দ্বারা শুদ্ধির নাম বাহ্য বা দেহশুদ্ধি। আর ইন্দ্রিয় সংযম ও রিপু সংযম দ্বারা মনকে শাস্ত্র কর্তৃক নিষিদ্ধ বাক, কর্ম বা আচরণ থেকে রক্ষা করার নাম অভ্যন্তর বা চিত্ত শুদ্ধি। দেহ ও মন এর যুগপৎ শুদ্ধি ছাড়া ধর্ম কর্ম করলে সবই বৃথা হবে। দেহ ও মন উভয় শুদ্ধি ব্যতিরেকে কোন প্রার্থনায় অংশগ্রহণই শাস্ত্রসম্মত নয়।
পবিত্র অপবিত্র অসহায় চিন্তা মাত্রে সবাই শুদ্ধ হয়।
বেদ ও মনুসংহিতায় বলা হয়েছে—
যার বাক্য ও মন পরিশুদ্ধ হয়েছে (অর্থাৎ যিনি মিথ্যা কথা বলেন না এবং রাগ দ্বেষাদি দ্বারা যার মন দূষিত হয়নি), যার বাক্য ও মন নিষিদ্ধ বিষয় থেকে সর্বদা সুরক্ষিত, সেই ব্যক্তি বেদমধ্যে ব্যবস্থাপিত মুক্তি লাভের হেতুস্বরূপ সর্বজ্ঞত্ব, সর্বেশ্বরত্বরূপ সমস্ত ফলপ্রাপ্ত হন (মনুসংহিতা, ২/১৬০)।
কাজেই দেখা যায়, ধর্মকর্ম পালন ও 'ঈশ্বর' প্রাপ্তি বা পরম গতি লাভের ক্ষেত্রে দেহ ও মনের শূচিতা অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় স্বরূপ। তবে মনে রাখবেন, দেহ ও মনের শূচিতা, ধর্মরক্ষার পাশাপাশি দেহ ও মনকে সুস্থ ও নিরোগ রাখে। তাই আসুন শাস্ত্রের আলোকে আমরা শূচিতার দীক্ষা নেই।
পবিত্র বা অপবিত্র যে কোন অবস্থাতেই শ্রীবিষ্ণুর নাম স্মরণ করলে তাঁর বাহির ও ভেতর পবিত্র হয়ে যায়। সে বিষ্ণুকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম। (বিষ্ণুর আরেক নাম— পুণ্ডরীক)। তাই বাহ্য শরীর ও শরীরের অভ্যন্তরে স্থিত মনের কোনো একটি বা দুটিই যদি অপবিত্র হয়, তবে পদ্মলোচন শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করা মাত্রই বাহ্য ও অন্তরে শুদ্ধ হওয়া যায়।
প্রাণী যেমন সূর্য্যের সাহায্যে শুদ্ধনেত্র দ্বারা মূর্তিমান পদার্থকে দর্শন করে; ধার্মিক বিদ্বানেরা শুদ্ধ জ্ঞাননেত্র দ্বারা তেমনই জীবের মধ্যে পরমাত্মাকে সদা দর্শন করেন।
(ঋগ্বেদ ১/২২/২০)
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম;
হর হর মহাদেব।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার