বেদে ভগবান শিবের কথা একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষত রুদ্র রূপে। রুদ্র হল শিবের একটি প্রাচীন রূপ, যাকে বেদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঋগ্বেদ— রুদ্রকে ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তাঁকে প্রশান্ত, নিরাময়কারী এবং রক্ষাকারী দেবতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, (ঋগ্বেদ, ২/৩৩), (ঋগ্বেদ, ১/৪৩), এবং (ঋগ্বেদ, ৭/৪৬) মণ্ডলগুলিতে রুদ্রের কথা উল্লেখ রয়েছে (How is Lord Shiva revealed in the Rig Veda?)
যজুর্বেদ— যজুর্বেদের শ্রী রুদ্রম অংশে শিবের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে, "নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ" এই মন্ত্রটি খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয়। (Which verse of Sri Rudram of Yajurveda has the word "Shiva"?).
অথর্ববেদ— অথর্ববেদে রুদ্রকে পশুপতি এবং নীললোহিত নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও, অথর্ববেদের বিভিন্ন অংশে রুদ্রকে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। (What is the Vedic Origin of Lord Shiva?).
শতপথ ব্রাহ্মণ— শতপথ ব্রাহ্মণেও রুদ্রের বিভিন্ন রূপের উল্লেখ রয়েছে, যেমন মৃগব্যাধা রূপে।
সারসংক্ষেপে, বেদের বিভিন্ন স্থানে ভগবান শিবকে রুদ্র নামের অধীনে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তাঁর ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলী এবং রূপের কথা বলা হয়েছে। শিব উপাসনার প্রাচীনতা, শিব হলেন আদি যোগী। তিনি স্বয়ম্ভু সনাতন হিন্দুধর্মে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভগবান শিব তথা রুদ্রের উপাসনা রয়েছে।
বেদের রুদ্র প্রাচীনতার একটি দিক। সেখানে রুদ্রসূক্তে নানা ভাবে ভগবান শিবের মাহাত্ম্য তথা রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। বেদের বহু পূর্বে হরপ্পা সভ্যতায় আদি যোগী পশুপতি মহাদেবের পুজো ছিল বলে জানা যায় একটি প্রাচীন মূর্তি থেকে। পশুপতি মহাদেবের এই মূর্তিটি পাথরের তৈরি। এই মূর্তির চারিদিকে পাঁচটি পশুর ছবি রয়েছে। অর্থাৎ এদিক থেকেও শিবের উপাসনার প্রাচীনতা স্পষ্ট।
"আদি যোগী" কথাটির মধ্যেও ভগবান শিবের প্রাচীনতার ইঙ্গিত রয়েছে। পুরান মতে সৃষ্টির প্রাক্কালে এক অনাদি অনন্ত লিঙ্গ বর্তমান ছিল। তার থেকেই সৃষ্টি বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর নাভি পদ্ধ থেকে সৃষ্টি ব্রহ্মার। এই অনাদি অনন্ত লিঙ্গই পরবর্তীতে মহাদেবের আকৃতি ধারণ করেন। এই কাহিনী ও শিব উপাসনার প্রাচীনতা ইঙ্গিত করে। সবশেষে বলা যায় সেই উপাসনা যে বহু প্রাচীন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে নয় তারও পূর্বে পশুপতি মহাদেবের উপাসনা ছিল তা ইতিহাস ঘাটলেই উজ্জ্বল রূপে ফুটে ওঠে।
বর্তমানে আমরা ভগবান শিবের অভিষেক এবং সকল বিভিন্ন রোগনাশের জন্যে "এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম" মন্ত্র এবং শিবের উপাসনার প্রধান মন্ত্র "ওঁ নমঃ শিবায় " জপ করি। এ সকল মন্ত্রই বেদ থেকেই নেয়া। মৃত্যু প্রত্যেকের জীবনেই নিশ্চিত। গাছের একটি পাকা ফল আম বা পেপে পেকে টশটশে হয়ে নিজেই গাছ থেকে ঝরে পরে। ঠিক সেভাবেই পূর্ণায়ু পেয়ে আমরা যেন আমাদের দেহরূপ প্রদীপকে যাঁর থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই সমর্পণ করতে পারি ভগবানের কাছে এমনই আমাদের প্রার্থনা করা উচিত। আমরা কেউ অনন্তকাল বেঁচে থাকতে থাকতে পারব না। মহাকাল রুদ্রের প্রতি সমর্পিত বেদের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রে ঠিক এ সমর্পণ ভাবটিই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
এ্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোমুক্ষীয় মামৃতাৎ।।
(ঋগ্বেদ, ০৭/৫৯/১২)
অনুবাদ— হে পরমেশ্বর, ধর্তা ও হর্তা পরমাত্মন, তুমি আমাদের জন্য সুগন্ধিত, পুষ্টিকারক তথা বলবর্ধক ভোগ্য বস্তু দান করো। আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে তোমার ভজন করি। হে পরমেশ্বর, আমরা পূর্ণায়ু ও পূর্ণভোগ করেই যেন এই শরীর রূপী বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি।
হে পরমেশ্বর রুদ্র, আমরা তোমার বন্দনা করি। তুমি জন্ম, জীবন ও মৃত্যুত্রয়ীর জ্ঞানদৃষ্টির অধিকারী। তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের যোগানদাতা। তুমি সকল ভয়ঙ্করব্যধি হতে ত্রানকারী। আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তিদান কর।
পবিত্র বেদের শুক্ল যজুর্বেদীয় মহারুদ্র
শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রীপাঠ রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী মহারুদ্রের আরাধনা, শিবলিঙ্গের উপর দুধ, দই, ঘি, মধু, সর্করা, গঙ্গাজল প্রদান করা হয়ে থাকে শ্রীঙ্গীর দ্বারা শিবলিঙ্গের উপরে অভিষেক হতে থাকে আর এই বেদমন্ত্র পাঠ চলতে থাকে তা ব্রাহ্মণ দিয়ে করানো হয় এই রুদ্রাভিষেক শিব পূজা। এই রুদ্র শিব পূজা করাতে পারলে মানুষের জীবনের সর্বচ প্রাপ্তি হয়ে থাকে সফলতা, রোগমুক্ত, দীর্ঘাযু, অকাল মৃত্যুবরণের হাত থেকে রক্ষা করেন মহারুদ্র মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব।
মনঃ শিব-সঙ্কল্পমস্তু।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ৩৪)
আমার মন শুভ কল্যাণকর সঙ্কল্পযুক্ত হোক।
এই শুক্ল যজুর্বেদীয় রুদ্রাধ্যায়ী সম্পর্কে একটি ধারণা বেদের মধ্যে ভগবান শিব কে আমরা রুদ্র নামে জানি। পূর্বকালে হইতে শ্রদ্ধালু বেদধ্যায়ী মানুষ গন অাত্মকল্যাণের শুক্লযজুর্বেদ থেকে আট উপযোগী অধ্যায় কে চরণ করে "রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী" নামক গ্রন্থ হয়।
এই রুদ্র শিব হল অন্যতম জনপ্রিয় একটি হিন্দু মন্ত্র এবং শৈব সম্প্রদায়ের তাৎপর্যবাহী মন্ত্র। নমঃ শিবায়-এর অর্থ হল "ভগবান শিবকে নমস্কার" বা "সেই মঙ্গলময়কে প্রণাম!" করা এই মহারুদ্র শিবকে পঞ্চাক্ষর মন্ত্রও বলা হয় যার মানে "পাঁচ-অক্ষরযুক্ত" মন্ত্র (ওঁ ব্যতীত)। এটি ভগবান মহারুদ্র শিবের প্রতি সমর্পিত হওয়া। এই মন্ত্রে শ্রী রুদ্রম্ চমকম্ ও রুদ্রাষ্টাধ্যায়ীতে "ন", "মঃ", "শি", "বা" এবং "য়" রূপে প্রকাশিত। শ্রী রুদ্রম্ চমকম্, কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ এবং রুদ্রাষ্টাধ্যায়ী, শুক্ল যজুর্বেদ-এর অংশ।
মহাদেব শিব মহারুদ্র দেখুন যজুর্বেদে রুদ্র স্তুতি—
ওঁ নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ।
বাহুভ্যামুত তে নমঃ।।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/১)
ওঁ যা হে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী।
তয়া নস্তন্বা শম্তময়া গিরিশম্তাভি চাকশীহি।।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২)
ওঁ নমো ভবায় চ রুদ্রায় চ নমঃ শর্বায় চ পশুপতয়ে
চ নমো নীলগ্রীবায় চ শিতিকন্ঠায় চ।।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২৮)
ওঁ নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/৪১)
যজুর্বেদ এর রুদ্র স্তুতির অনুবাদ—
হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশ্য নমস্কার, তোমার বাণ ও বহুযুগলকে নমস্কার করি।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/১)
হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময়, সৌম্য, পূণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও। হে গিরিশ, তুমি হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না। জগতের সকল নীরোগ ও শোভনমনস্ক হোক। তুমি সকলের পূজ্য ও দেবগণের হিতকারী ভিষক।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২)
ভব ও রুদ্রকে নমস্কার। পশুপতিকে নমস্কার। নীলগ্রীব ও শিতিকণ্ঠকে নমস্কার।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/২৮)
মুক্তি সুখ ও সাংসার সুখ দাতা রুদ্রকে নমস্কার, লৌকিক ও মোক্ষসুখের কারক রুদ্রকে নমস্কার, যিনি কল্যাণরুপ ও ভক্তজনের কল্যাণ-বিধাতা সে রুদ্রকে নমস্কার। গোসমূহে জাত ও গোষ্ঠে জাত, তীর্থে ও কূলে জাত, পাষাণে বা স্থির জলে জাত, অরণ্যপ্রদেশে ও গিরিগুহায় জাত এবং ধূলিতে ও পরাগে জাত রুদ্রকে নমস্কার। রুদ্রের দেবতার অগ্নি, বায়ু ও সূর্য দেবতাদের নমস্কার।
(শুক্ল যজুর্বেদ, ১৬/৪১)
ঋগ্বেদীয় রুদ্র বেদি সিন্ধু মন্ত্র পড়বেন—
ওঁ শন্নো ইন্দ্রো বসুভির্দেবো অস্তু শমাদিত্যেভির্বরুণঃ সুশংসঃ।
শং নো রুদ্রো রুদ্রেভির্জলাষঃ শংনস্ত্বষ্টা গ্নাভিরিহ শৃণোতু।। (৬)
শং নঃ সোমো ভবতু ব্রহ্ম শং নঃ শং নো গ্রাবাণঃ শমু সন্তু যজ্ঞাঃ।
শং নঃ স্বরুণাং মিতয়ো ভবন্তু শং নঃ প্রস্বঃ শম্বস্তু বেদিঃ।। (৭)
শন্নঃ সূর্য্য উরুচক্ষা উদেতু শন্নশ্চতস্র প্রদিশো ভবন্তু।
শং নঃ পর্বতা ধ্রুবয়ো ভবন্তু শং নঃ সিন্ধবঃ শমু সন্ত্বাপঃ।। (৮)
(ঋগ্বেদ, ৭/৩৫/৬-৮)
ঋগ্বেদীয় রুদ্র বেদি সিন্ধু মন্ত্র অনুবাদ—
ঐশ্বর্য্যময় প্রভু আমাদিগকে নিবাস স্থানে আমাদের কল্যাণ করুন। বরণীয় পরমাত্মা সূর্য্য কিরণ দ্বারা কল্যাণ করুন। শান্তিদাতা পরমাত্মা স্বীয় তেজ দ্বারা আমাদের মঙ্গল বিধান করুন। জগতের স্রষ্টা আমাদিগকে বাণী প্রদান করিয়া কল্যাণ করুন এবং আমাদের এই আহ্বান শ্রবণ করুন। (৬)
মেধাবর্দ্ধক ওষধি আমাদের জন্য সুখদায়ক হউক। বেদ পাঠ আমাদের মঙ্গল দান করুক, শিলা ও যজ্ঞ আমাদের জন্য শান্তিপ্রদ হউক। বেদির স্তম্ভ ওষধি এবং বেদির অন্যান্য দ্রব্য আমাদের মঙ্গল দায়ক হউক। (৭)
জ্যোতির্ময় সূর্য্য আমাদের জন্য কল্যাণকারী রুপে উদিত হউক। চারিদিক আমাদের জন্য সুখময় হউক। অচল পর্বত, সচল সিন্ধু এবং জলরাশি আমাদের সুখ দান করুক। (৮)
ওঁ
ব্রহ্মা + ব্রহ্মাণী + মহাসরস্বতী
বিষ্ণু + বৈষ্ণবী + মহালক্ষ্মী
শিব + শিবানী + মহাকালী
ব্রহ্ম + শক্তি
পুরুষ + প্রকৃতি
চন্দ্র ও চন্দ্রের কিরণ দুধ ও দুধের ধবলতার ন্যায় এক ও অভেদ।
শিব শব্দের অর্থ ও কল্যাণ। সেই কল্যাণ স্বরূপ ব্রহ্মই শিব। বেদে এবং উপনিষদে তাকে রুদ্র নামে অভিহিত করা হয়েছে।
জগতের স্রষ্টা এবং জগতের আধার এক অদ্বিতীয় ব্রহ্ম ও তাঁর অবিচ্ছেদ্য শক্তিকেই আমরা বিভিন্ন নামে অভিহিত করে, বিভিন্ন রূপে তাঁকে উপাসনা করি। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই সেই ব্রহ্মের ক্রিয়াশীল শক্তি, তিনিই পুরুষ এবং তিনিই জগতের আধার প্রকৃতি। সেই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর যখন জগত সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা নামে অভিহিত হন। সেই ব্রহ্মারই সত্ত্বগুণ সম্পন্না শক্তি হলেন ব্রহ্মাণী। এ ব্রহ্মাণীই সরস্বতী, গায়ত্রী, সাবিত্রী সহ বিভিধ নামে অভিহিতা। সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের পালন রূপের নাম বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর রজোগুণ সম্ভূতা ক্রিয়াশীল শক্তির নাম বৈষ্ণবী বা লক্ষ্মী।
পরমেশ্বরের ধ্বংস বা প্রলয় রূপের নাম শিব বা মহেশ্বর। এ মহেশ্বরের তমোগুণ সম্ভূতা ক্রিয়াশীল শক্তির নাম মাহেশ্বরী বা কালী। অর্থাৎ তিনি এক, কিন্তু রুচির বৈচিত্র্যময়তার জন্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁর প্রকাশ অনন্ত। সনাতন ধর্মানুসারে চিন্তার অতীত পরমেশ্বর যে রূপে সৃষ্টি করেন সেই রূপের নাম ব্রহ্মা, যে রূপে জগৎ পালন করেন সেই রূপের নাম বিষ্ণু এবং যে রূপে লয় বা নাশ করেন সেই রূপের নাম শিব বা মহেশ্বর। এ সহজ কথাটিই শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে।
"প্রকৃতির তিনটি গুণ-সত্ত্ব, রজ এবং তম। পরমেশ্বর এক হলেও এই তিনটি গুণের প্রভাবে বিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জন্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপ ধারণ করেন।"
উপাস্য হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে উপাসনা করলেও আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূলত এক ব্রহ্মেরই অনন্ত রূপ-রূপান্তরের উপাসনা করি। তাই বর্তমানের কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কথায় সংশয়াছন্ন না হয়ে আমরা আমাদের পূর্ববর্তী ঋষি-মুনিদের পথেই সাকার-নিরাকারের সমন্বয়েই অধিকারী ভেদে এক পরমেশ্বরের উপাসনা করি।
শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ বলছে—
একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থূ।
রুদ্র এক এবং অদ্বিতীয়। অর্থাৎ এখানে বোঝা যাচ্ছে পরমাত্মা শিব এক এবং অদ্বিতীয়।
ঋষি মন্ত্রে বলেছেন—
যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহ পাপকাশিনী।
তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভিচাকশীহি।।
হে রুদ্র, হে গিরিশন্ত, তোমার যাহা মঙ্গলময়, প্রসন্ন ও পাপবিনাশক তনু, সেই সুখতম তনুর সহিত আমাদিগের নিকট প্রকাশিত হও। পরমেশ্বর বাস্তবে নিরাকার। কিন্তু ভক্তের ভাবে তিনি সাকার। ঋষি প্রথমে পরমেশ্বরের এক এবং অদ্বিতীয় স্বরূপের কথা বর্ণনা করলেন। পরবর্তী মন্ত্রে তিনি তার দিব্য তনুর ব্যাখ্যা করলেন।
পরমেশ্বরের নিরাকার স্বরূপটি, যোগীর কাছে অধিক প্রিয়। আবার সাকার স্বরূপটি ভক্তদের কাছে প্রিয়। তাহাকে জানলেই এই ভবসাগর পারাপার হয়ে যায়।
মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি ঘটে, অচিরেই ব্রহ্ম
জ্ঞানলাভ পূর্বক, নির্বাণ সুখ অনুভূত হয়।
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাহ তিমৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ য়নায়।
আমি পরিপূর্ণ, সর্বাধিক, স্বয়ং প্রকাশ ও অবিদ্যার অতীত ইহাকে জানিয়াছি; তাহাকেই মাত্র জানিয়া মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া থাকেন; (সংসার) উত্তরণের অন্য কোন ও মার্গ নাই।
মহাদেব শিব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ—
শিব শব্দটির উল্লেখ বেদে আছে তবে তা রুদ্রের বিশেষণে। পৌরাণিক শিব এবং বৈদিক রুদ্র এক অভিন্ন। শিবের আটটি বিশেষ রূপকে একত্রে অষ্টমূর্তি বলে। এঁরা হলেন—ভব (অস্তিত্ব), শর্ভ (ধনুর্ধর), রুদ্র (যিনি দুঃখ ও যন্ত্রণা প্রদান করেন), পশুপতি (পশুপালক), উগ্র (ভয়ংকর), মহান বা মহাদেব (সর্বোচ্চ আত্মা), ভীম (মহাশক্তিধর) ও ঈশান (মহাবিশ্বের দিকপতি)। মহাদেবের গাত্রবর্ণ রজতগিরিনিভ অর্থ্যাৎ রুপালী পর্বতের ন্যায় শ্রভ্রবর্ণের। বৈদিক শিব পরমাত্মাবাচক। "শিবু কল্যাণে" ধাতু থেকে শিব শব্দ নিষ্পন্ন যার অর্থ শান্ত, মঙ্গলদায়ক, কল্যাণকারক প্রভৃতি। আর রুদ্র রোদনে অর্থাৎ যিনি পাপী-তাপীকে রোদন করান তিনিই রুদ্র। আবার আমাদের মৃত্যুর সময় দশ প্রাণ ও আত্মা এই একাদশ রোদন করে বলে নাম একাদশ রুদ্র।
অনেকে বলেন, সৃষ্টিকর্তা কখনোই সাকার হতে পারেন না। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সৃষ্টিকর্তা যদি সর্বশক্তিমান হন তবে তিনি সব পারেন, আর যদি না পারেন সেটা তার কাছে ব্যর্থতা; তখন তিনি আর সর্বশক্তিমান নন। তাইতো ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে—
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি,
অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।
(ঋগ্বেদ, ০১/১৬৪/৪৬)
"সেই এক পরমেশ্বরকেই আমরা অগ্নি, যম, মাতরিশ্বান সহ বিভিন্ন নামে অভিহিত করি।"
আমরা পরমেশ্বরকে বিভিন্ন নামে এবং রূপে অভিহিত করলেও তিনি বহু নন, তিনি আদতে একজনই। সেই আছেন অনন্তরূপে পরিব্যাপ্ত এক ঈশ্বরের করুণায় তিনি আমাদের এই জগত পূর্ণ হয়ে রয়েছে।
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম;
হর হর মহাদেব।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার