জল সমাধি অর্থাৎ জলে দেহ সলিল সমাধি।
সমাধি বহুপ্রকার সেই সমস্ত প্রকারের মধ্যে অন্যতম হল জলে সলিল সমাধি। কিছুদিন আগে রামমন্দিরের পুরোহিত মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের দেহ জলসমাধি হয়েছিল। শ্রীরাম মন্দিরের পুরোহিত এর জল সমাধি নিয়ে শুরু হল বিতর্ক, তার মধ্যে সনাতনী হিন্দুরাও এই বিতর্কে সামিল হয়েছে।
কেউ জানেন,
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ব্রহ্মজি ও যমরাজের অনুরোধে অযোধ্যের সরযূর নদীতে জল সমাধি গ্রহণ করেছিলেন। যে সরযূর নদী যেখানে ভগবান স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র জলে সমাধি নিয়েছিলেন।
সনাতনীরা আগে সবটা জানুন তারপর বিতর্ক করুন!
শ্রীরাম মন্দিরের পুরোহিতের দেহ দাহ বা মাটিতে সমাধি নয়, শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি অযোধ্যার প্রধান পুরোহিত মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের দেহ শরীরে বাঁধা হল ভারী বস্তু চুন, লবণ, পাথর ও বালির বস্তা বেঁধে নৌকো থেকে সরযূর জলে সমাধি দেওয়া হল।
নৌকো থেকে সরযূর জলে শ্রীরাম মন্দিরের পুরোহিতের দেহ সমাধি নয়। অগ্নিতে সৎকার নয়। শাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি অযোধ্যার প্রধান পুরোহিত মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের দেহকে দেওয়া হল জলে সলিল সমাধি। বহু প্রাচীন এই প্রথা খুবই বিরল। শুক্রবার পুরোহিতকে জল সমাধি দেওয়ার ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে নেটমাধ্যমে। এমন শেষকৃত্য দেখে অনেকেই বেশ অবাক হয়েছেন। তবে এই প্রথায় জলে দেহ সমাধিস্থ করার রীতি নাকি বহু সাধক সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই প্রচলিত। সরযূ নদীর তীরে অযোধ্যা। রামায়ণের গল্পে বিভিন্ন ভাবে জুড়ে রয়েছে সরযূ নদীর সঙ্গে।
বুধবার লখনউয়ের পিজিআই হাসপাতালে প্রয়াত হন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসে। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ১৯৯৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে শ্রীরাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত-পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি এক সময় রামলালা যখন মন্দিরের বাইরে অস্থায়ী তাঁবুতে ছিলেন, তখন থেকেই মহন্ত সত্যেন্দ্র দাস ছিলেন নিত্যপুজোর দায়িত্বে। এরপর বহু ঘটনা, বহু আইনি লড়াইয়ের পর ২০২৪ সালে শ্রীরাম মন্দিরে রামলালার নতুন মূর্তির অভিষেক। সব সময় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে, বিশেষ করে অযোধ্যা শহরে শোক নেমে আসে।
অযোধ্যা শ্রীরামচন্দ্রের জন্মভূমি মন্দিরের প্রয়াত প্রধান পুরোহিত মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের রামানন্দী রীতি অনুসারে সরযূ নদীতে জলে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস, এভাবে জলে সলিল সমাধি হলে গোলোকে স্থান পান। তাই তাঁকে আর জন্ম নিতে হয় না। আত্মার মুক্তি মেলে তাই নিয়ম অনুসারে সত্যেন্দ্র দাশের দেহও হনুমানগড়ি ঘুরে সরযূ ঘাটে গিয়ে জলে সলিল সমাধিস্ত করা হয়। বৈদিক মন্ত্র পাঠের পর সরযূর জলে সমাহিত হয় তাঁর দেহ।
আমাদের সনাতন ধর্মে অগ্নিতে দাহ করার রীতিই প্রচলিত। তবে অনেক সাধক সাধুসন্ত ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে জলে সলিলসমাধি ইটাই প্রথা। ভিডিও দেখা গিয়েছে, ধর্মীয় উপাচারের পর তাঁর দেহ নৌকোয় করে নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সকলে মিলে ঠেলে সেই দেহ জলে ফেলে দেন। দেহ নিমজ্জিত করার আগে তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় ভারী বস্তু চুন, লবণ, পাথর ও বালির বস্তা। যাতে একেবারে সলিল সমাধি ঘটে দেহর যাতে কোথাও ভেসে না ওঠে এই দেহ। দেহ শায়িত অবস্থায় ভাসানো হয় না। দেহ থাকে সিদ্ধ যোগ মুদ্রায়। অর্থাৎ তিনি যেন ধ্যানমগ্ন, সেই ভাবেই দেহ জলে দেওয়া হয়।
আমাদের সনাতন ধর্মে বিশ্বাস, ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্রও নিজে হেঁটে এই সরযূর জলে মিলিয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই এই জলসমাধির রীতি। বিভিন্ন সন্ন্যাসী, সম্প্রদায়ে সৎকারের পদ্ধতি আলাদা আলাদা। কেউ দেহ দাহ করেন, কারও হয় জলে সলিল সমাধি এবং কাউকে মাটির নিচে শায়িত করা হয়।
হিন্দুধর্মের রামায়ণ, মহাভারত এবং অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে, ঋষি-সন্তদের জলে সমাধি দেওয়ার বর্ণনা রয়েছে। বৃন্দাবনের বিশিষ্ট সাধক দেবরাহ বাবা এবং অনেক সাধুর জল সমাধির মাধ্যমে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। মহন্ত সত্যেন্দ্র দাসের শেষকৃত্যও জল সমাধি রীতি অনুসারে সম্পন্ন হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, জল সমাধির মাধ্যমে আত্মা দ্রুত মোক্ষ লাভ করে। এর কারণ হল, জল একটি পবিত্র এবং বিশুদ্ধ উপাদান।
তোমরা আদেও হিন্দু কিনা এবং হিন্দু প্রথা জানো কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ রেখো না কারণ তোমার এই ভিডিওর মাধ্যমে তুমি বুঝিয়ে দিলে যে তুমি জানো না। সনাতন শাস্ত্র ও ভারতবর্ষকে জানা প্রয়োজন, সনাতন শাস্ত্র ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিকতাকে জানা প্রয়োজন।
বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের সনাতন শাস্ত্রে বিধান আছে,
সন্ন্যাসীদের মৃতদেহ দাহ হয় না। তবে সব সন্ন্যাস মার্গে এই বিধান প্রচলিত নেই। দশনামী সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েকটি সলিল সমাধিতে বিশ্বাস রাখে। কারণ সন্ন্যাসী সংসারত্যাগী। তার কোনো অপত্য থাকতে পারে না। সুতরাং তার মুখাগ্নি সম্ভব নয় তাই সে কারণেই তাদের দেহ জলে সলিল সমাধি দেওয়া হয়।
সন্ন্যাসীদের জল সমাধি আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক এক প্রথা হিন্দুধর্মে কিছু উচ্চতর সন্ন্যাসীদের দেহ দাহ না করে জল সমাধি দেওয়া হয়। যেখানে তাঁদের দেহ পবিত্র নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। এর পিছনে রয়েছে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বিশ্বাস—
১) পঞ্চভূতে বিলীন হওয়া – সাধুরা মৃত্যুর পর প্রকৃতির সাথে একাত্ম হন, তাই তাঁদের দেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
২) মোক্ষ লাভের প্রতীক – বিশ্বাস করা হয়, তাঁরা পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চিরতরে মোক্ষ প্রাপ্ত হন।
৩) যোগসিদ্ধির ফল – কিছু সাধুর দেহ বিশেষ যোগচর্চার কারণে দীর্ঘ সময় অবিকৃত থাকে, তাই তাঁদের দাহ করা হয় না।
শতাব্দী প্রাচীন এই প্রথাটি মূলত শৈব, বৈষ্ণব ও তান্ত্রিক যোগীদের মধ্যে প্রচলিত। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ও পুরাণে বিভিন্ন সাধুসন্ত ও সন্ন্যাসীদের জল সমাধির উল্লেখ পাওয়া যায়। নর্মদা, গঙ্গা, যমুনা ও গোদাবরীর তীরে অনেক নর্মদা পরিক্রমাকারী সাধুসন্ত ও সন্ন্যাসীদের জল সমাধি দেওয়া হয়। বিশেষত উদাসীন ও নাগা সন্ন্যাসীরা এই প্রথা অনুসরণ করেন। বারাণসী, হরিদ্বার, অযোধ্যা, ঋষিকেশ ও উজ্জয়িনীর মতো অনেক স্থানে এখনও এই প্রথা দেখা যায়। এটি শুধুই এক ধর্মীয় রীতি নয়, বরং গভীর আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রতিফলন।
যাই হোক এই বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন, তোমরা এটা নাই জানতে পারো তাই বলে সব জায়গায় শাস্ত্রের বিরুদ্ধে বিতর্ক ভালো নয়।
There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy” - William Shakespeare.
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীরাম,
হর হর মহাদেব।
পবিত্র বেদের বাণী ও সকল বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে পেতে আমার সাথে এবং আমাদের পেইজে চোখ রাখুন।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার