আমাদের সনাতন ধর্মে কি নারীদের ঋতুস্রাবকালীন পিরিয়ডের সময়ে স্রষ্টার উপাসনা করা বা বৈদিক ধর্মীয় কাজকর্ম করা কি নিষিদ্ধ?
সনাতন ধর্মে নাকি নারীদের ঋতুস্রাবকালীন অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে এই বিষয় নিয়ে সনাতনধর্মে শুদ্ধতা ও পবিত্রতার এই বিষয়টা নিয়ে দেখা যাক চলুনঃ—
शुद्धाः पुता योषितो यज्ञिया इमा आपश्चरुमब सर्पन्तु शुभ्राः ।
अदुः प्रजां बहुलान्पशुन्नः पक्तौदनस्य सुकृतामेतु लोकम् ।।
(अथर्ववेद कन्द–११॑ सुक्त–१॑१७)
শুদ্ধাঃ পুতা যোষিতো যজ্ঞিযা ইমা আপশ্চরুমব সর্পন্তু শুভ্রাঃ ।
অদুঃ প্রজাং বহুলান্পশুন্নঃ পক্তৌদনস্য সুকৃতামেতু লোকম্ ।।
(অথর্ববেদ ১১/১/১৭)
অনুবাদঃ– শুদ্ধ, পবিত্র ও পূজনীয় রমণীগণ ও তাঁদের পবিত্র কর্ম জলের ধারার মতো পবিত্র পাত্রে প্রবেশ করুক ও যজ্ঞের জন্য পবিত্র ভোগ্যবস্তু তৈরি হোক। তাহারা আমাদের উত্তম বংশধর ও প্রভূত ধনসম্পদ দান করুন। যারা অমৃতসত্তার জন্য উৎকৃষ্ট খাদ্য তৈরি করে, তারা যেন জীবনের সর্বোচ্চ অর্জনের শিখরে পৌঁছান।
May these pure, consecrated, adorable gracious young women and their holy actions like gentle streams of water move to the sacred vessel to prepare the holy food for yajna for the community on way to divinity. May they give us noble progeny and plenty of wealth, and may those who prepare and perfect the food for divinity reach the regions of highest attainment in life. (Atharva-Veda Kanda–11/Sukta–1/17)
বাংলা অর্থঃ— এই বিশুদ্ধ, পবিত্র, অতিথিবান যুবতী নারীরা এবং তাদের পবিত্র কাজগুলি যেন পবিত্র নৌযানের মত পবিত্র জাহাজের দিকে চলে যায় এবং পবিত্রতার জন্য পবিত্র খাদ্যের জন্য যজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আমাদের উন্নতচরিত্র বংশধর এবং প্রচুর সম্পদ দিতে পারে, এবং যারা ডিভাইনের জন্য খাদ্য প্রস্তুত এবং নিখুঁত করতে পারে তারা জীবনের সর্বোচ্চ অর্জনের ক্ষেত্রগুলিতে পৌঁছাতে পারে।
(Atharva-Veda Kanda–11/Sukta–1/17)
(Tulshi Sharma Translation).
আমাদের সনাতন ধর্মে নারীর ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মিথ্যা কুসংস্কার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বর্বর ধর্মমতসমূহ এই সময়ে স্রষ্টার উপাসনা করা বা ধর্মীয় কাজকর্ম নিষিদ্ধ করা নারীকে অপবিত্র বলা ঠিক নয়।
সনাতন ধর্ম বিষয়টি নিয়ে কি বলেছে দেখুন—
সনাতনধর্ম সর্বোৎকৃষ্ট মানবতাবাদী ধর্ম। আর সনাতন ধর্মশাস্ত্র বিশেষ করে বেদে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা দান করা হয়েছে। বেদে নারীদের সর্বদা শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে।
কারণ আমাদের সনাতন ধর্মে একসময় নারী ঋষিরা বৈদিক যুগে বেদ শাস্ত্রপাঠ করতেন এবং বেদদ্রষ্টা নারী ঋষি ও ছিলেন। তাই বৈদিক যুগে কিন্তু নারী ঋষিরা সকলের সঙ্গে সভা প্রভৃতিতে যোগদান করিতে পারিতেন। (ঋগ্বেদে, ১/১৬৭/৩) দেখি এই বিষয়ে—
यावा॑ स॒भाव॑ती विद॒थ्य॑व॒ सं वाक ॥
যোষো সভাবতী বিদথ্যেব সং বাক্।
ঋগ্বেদে (১/১৬৭/৩)
অনুবাদঃ— সেই বাণী সভা ও বিদ্বজ্জনের উপযুক্তা নারীর মত রয়েছে।
পবিত্র বেদে সরাসরি ঋতুকালীন বিধিবিধান বিস্তারিত নেই। কেননা বেদদ্রষ্টা ঋষিরা জানতেন এটা স্বাভাবিক বিষয়। ঋতুকালীন বিধিনিষেধ ও নারীদের শুদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত আছে ধর্মসূত্র (বেদাঙ্গ কল্পের অন্তর্গত বিধানসমগ্র) ও স্মৃতিতে রয়েছে।
সনাতন ধর্মের (বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২৮/২-৩) এতে বর্ণিত রয়েছে—
A wife, (though) tainted by sin, whether she be quarrelsome, or have left the house, or have suffered criminal force, or have fallen into the hands of thieves, must not be abandoned; to forsake her is not prescribed (by the sacred law). Let him wait for the time of her courses; by her temporary uncleanness she becomes pure. Vashistha Dharmasutra 28/2-3).
বাংলা অর্থঃ— একজন স্ত্রী, (যদিও) পাপ দ্বারা কলঙ্কিত, সে ঝগড়াটে হোক, বা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, বা ফৌজদারি শক্তি ভোগ করেছে, বা চোরদের হাতে পড়েছে, ত্যাগ করা উচিত নয়; তাকে ত্যাগ করার জন্য নির্ধারিত হয় না (পবিত্র আইন দ্বারা)। তাকে তার কোর্সের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে দিন; তার অস্থায়ী অশুচি দ্বারা তিনি খাঁটি হয়ে ওঠেন। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/২-৩)
ঋতুকালীন নারীদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি কোথাও। যেহেতু বারবার এই বিষয়টি বর্ণিত যে ঋতুস্রাবকালীন সময়ে নারী তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ করবে, তাই মন্দিরে প্রবেশাধিকার আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে পূজা করার অনুমতি আছে, (অঙ্গিরস স্মৃতি ৩৭) ও অগ্নির কাছে না যাবার কথা আছে। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ৫/৬)
নারীর তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ ও ঋতুকালীন সময় যে তার শুদ্ধতার পবিত্র প্রতীক তা মনুসংহিতা ও বশিষ্ঠ ধর্মসূত্রে বর্ণিত রয়েছে।
মৃত্তৌয়ঃ শুধ্যতে শোধ্যং নদী বেগম শুধ্যতে।
রজসা স্ত্রী মনোদুষ্টা সন্ন্যাসেন দ্বিজোত্তমঃ।।
(মনুসংহিতা, ৫/১০৮)
অনুবাদঃ— নারী মালিন শোধনীর বস্তু মৃত্তিকা ও জল দ্বারা শুদ্ধ হয়, (মলমূত্রাদি দূষিত) নদী স্রোতের দ্বারা শুদ্ধ হয়, স্ত্রীলোক মনে মনে (পরপুরুষকামনায়) দূষিত হলে স্ত্রীলোক ঋতু দ্বারা শুদ্ধ হয়, ও ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসের দ্বারা শুদ্ধ হয়।
সনাতন ধর্ম মতে নারী শুভময়ী যে মালিন বস্তু মৃত্তিকা ও জলাদি দ্বারা শুদ্ধ হয়, নদী শ্লেষ্মাদি-দূষিত হইলে শ্রোতে শুদ্ধ হয়। স্ত্রীলোক মনে মনে (পরপুরুষামুকী) দূষিত হইলে ঋতু হইলেই শুদ্ধ হয়, পাপাচরণ করিলে ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসের ব্রহ্মের চিন্তন দ্বারা শুদ্ধ হয়।
নারীর অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুমতি নেই?
সামাজিক অবস্থা, বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে ৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে—
সোমো দদদ্ গন্ধর্বায় গন্ধর্বোদদদগ্নয়ে। (১০, ৮৫, ৪১)
সোম ইঁহাকে দিলেন গন্ধর্বকে, গন্ধর্ব দিলেন অগ্নিকে।
এইকথা আসল তাৎপর্য কি?
গোভিলীয়-গৃহ্যসূত্র-পরিশিষ্টে দেখা যায় (২/১৭-১০)—
ঋতুমতী না হইলে কন্যাকে বলে ‘নগ্নিকা’; ঋতুমতী হইলে ‘অনগ্নিকা’, এই অনগ্নিকা কন্যাই বিবাহে দান করিতে হয়। নগ্নিকাকে ‘গৌরী’ এবং ঋতুমতী অনগ্নিকাকে ‘রোহিণী’ও বলে। যৌবন চিহ্ন দেখা না গেলে ‘কন্যা’, কুচাদিহীনাকেও ‘নগ্নিকা’ বলে। যৌবনব্যঞ্জন দেখা গেলে সোম সেই কন্যাকে গ্রহণ করেন (অর্থাৎ তখন সে সৌম্য হয়), পয়োধর হইলে গন্ধর্ব গ্রহণ করেন এবং ঋতুমতী হইলে অগ্নি তাহাকে গ্রহণ করেন। তাই অব্যঞ্জনোপেতা, অরজা, অপয়োধরা কন্যকাদান ভালো নয়, কারণ বেদে-উক্ত দেবতাদের সঙ্গে তাহার তখনও কোনো যোগ হয় নাই—
তস্মাদবাঞ্জনোপেতামরজামপয়োধরাম্।
অভুক্তাং চৈব সোমাদ্যৈঃ কন্যকাং ন প্রশস্যতে।
এইসব দেবতাদের সঙ্গে যোগের ও অধিকারী কথা যে অর্থবাদমাত্র তাহা বুঝা যায় বসিষ্টস্মৃতির এই মন্ত্রে দেখিয়া—
পূর্বঃ স্ত্রিয়ঃ সুরৈর্ভুক্তাঃ সোমগন্ধর্ববহ্নিভিঃ॥
অর্থাৎ, পূর্বে স্ত্রীগণ সোম গন্ধর্ব বহ্নির দ্বারা ভুক্ত। ইহার তাৎপর্যও পরশ্লোকেই তিনি বলিতেছেন, সোমদেবতা নারীকে দেন শুচিতা, গন্ধর্ব দেন শিক্ষিত বাণী, অগ্নি দেন সর্বভক্ষত, তাই নারীগণ নিষ্কল্মষ—
তাসাং সোমেঽদদচ্ছৌচং গন্ধর্বঃ শিক্ষিতাং গিরম্।
অগ্নিশ্চ সর্বভক্ষত্বং তস্মান্নিষ্কল্মষাঃ স্ত্রিয়ঃ।
(বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/৬)
বৌধায়নও এইকথা বলেন (বৌধায়ণ স্মৃতি, ২/২/৫৮)।
মহর্ষি অত্রি বলেন—
পূর্বং স্ত্রিয়ঃ সুরৈর্ভুক্তাঃ সোমগন্ধর্ববহ্নিভিঃ।
ভুঞ্জন্তে মানবাঃ পশ্চান্ ন তা দুয্যন্তি কর্হিচিৎ।। (৩২)
(স্মৃতীনাং সমুচ্চয় সংস্করণে, বসিষ্টস্মৃতি, আনন্দাশ্রম, ২৮/৫)
(অত্রিসংহিতা, মন্মথনাথ দত্ত সংহিতা, ৯০)
নারীর অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুমতি নেই, নারীর তপস্বিনীর ন্যায় আচরণ ও ঋতুকালীন সময় যে তার শুদ্ধতার প্রতীক। এটা মনুসংহিতা ও বশিষ্ট ধর্মসূত্রে বর্ণিত আছে।
ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা। (বৃহদারণ্যক, ৬/৪/৬)
মনের নিয়ন্ত্রণঃ— মন দি–রকমের। শুদ্ধ–অশুদ্ধ; পবিত্র–অপবিত্র। কামনা–বাসনা, ভোগ–লালসার যাবতীয় সঙ্কল্প বা ইচ্ছা হলো অশুদ্ধ মনের। আর শুদ্ধ বা পবিত্র মনের কোনো লৌকিক কামনা–বাসনা নেই।
(অমৃতবিন্দু উপনিষদ, ১)
অদ্ভির্গার্ত্রাণি শুধ্যন্তি মনঃ সত্যেন শুধ্যাতি।
বিদ্যাতপোভ্যাং ভূতাত্মা বুদ্ধি জ্ঞানেন শুধ্যতি ॥
(মনুসংহিতা, ৫/১০৯)
অনুবাদঃ— জলের দ্বারা দেহ, সত্য দ্বাবা মন, জীবাত্মা বিদ্যা ও তপস্যা দ্বারা এবং বুদ্ধি জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হয়।
ঈশ্বর (ব্রহ্ম) তুমি নারী, তুমিই পুরুষ; তুমি বালক, বালিকাও তুমি; তুমিই বৃদ্ধ, তুমিই নানা রূপে জন্ম নাও। (শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ৪/৩)
ঈশ্বর আত্মাতে নর–নারী ভেদ নেই। দেহে সম্বন্ধেই নর–নারী ভেদ। অতএব আত্মাতে নারী–পুরুষ ভেদ আরোপ করা ভ্রমমাত্র— শরীর সম্বন্ধেভ তা সত্য তাই অজ্ঞানই বন্ধনের মূল কারণ।
ভগবানের মন্দির জ্ঞানে সর্বভূতে প্রেমের দ্বারা সেই জ্ঞানলাভ হয়। তিনি সর্বভূতে অবস্থান করেন।
(চিরজাগ্রত স্বামী বিবেকানন্দ)
এবার আসুন আমরা এই বিষয়ে সম্পূর্ণ রেফারেন্স গুলো দেখি—
Soma gave them purification; the Gandharva, sweet speech; Agni, perfect purity; therefore verily women are always pure. — (Yajnavalkaya smriti 1.71).
বাংলা অর্থঃ— সোম তাদের পরিশোধন দিয়েছেন, গন্ধর্বর, মিষ্টি বক্তৃতা, অগ্নি, নিখুঁত বিশুদ্ধতা। অতএব সত্যই নারী সবসময় বিশুদ্ধ হয়।
অনুবাদঃ— নারীজাতি সোম থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত, গন্ধর্বদের থেকে সুমিষ্ট বাক্য প্রাপ্ত, অগ্নির কাছ থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত তাই নারীরা সর্বদা শুদ্ধ। (যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, ১/৭১)
Women (possess) an unequalled means of purification; they never become (entirely) foul. For month by month their temporary uncleanness removes their sins. — (Vashistha Dharmasutra 28.4).
বাংলা অর্থঃ— নারীর (অধিকারী) তাই তাদের এটা পরিশোধন একটি অসমাপ্ত উপায়। তারা (সম্পূর্ণরূপে) পবিত্র কখনো অপবিত্র হয় না। মাসের জন্য মাসে তাদের অস্থায়ী অশুচি তাদের মনের পাপ মুছে ফেলা।
অনুবাদঃ— নারীদের একটা অন্য ধরনের পবিত্রতা আছে। তারা কখনোই পুরোপুরি অপবিত্র হন না। মাসে মাসে কিছুদিনের অস্থায়ী অশৌচাবস্থা তাদের মনের পাপ ধুয়েমুছে দেয়। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/৪)
সনাতন ধর্মে নারীদের একটা অন্য ধরনের পবিত্রতা আছে। নারী (অধিকারী) শুদ্ধির একটি অসম উপায়; তারা কখনই (সম্পূর্ণরূপে) পবিত্র, তারা কখনো অপবিত্র হয়ে যায় না। মাসের পর মাস তাদের অস্থায়ী অশুচি তাদের পাপগুলি সরিয়ে দেয়।
Women belong first to three gods, Soma (the moon), the Gandharva, and Fire, and come afterwards into the possession of men; according to the law they cannot be contaminated. — (Vashistha Dharmasutra 28.5)
বাংলা অর্থঃ— নারী প্রথম তিনটি দেবতা, সোম (চাঁদ), গন্ধর্ব, এবং আগুনের অন্তর্ভুক্ত, এবং পরে পুরুষদের অধিকার মধ্যে অন্তর্গত। আইন অনুযায়ী তারা দূষিত করা যাবে না।
অনুবাদঃ— নারীরা তিন ধরনের দেবসত্তার অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে সোম (চন্দ্রের ন্যায় মাধুর্যময় ঈশ্বরের রূপ), গন্ধর্ব ও অগ্নি। এরপরে তারা পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী। তাই আইন শাস্ত্রমতে তারা কখনোই অশুদ্ধ হতে পারে না। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/৫)
Soma gave them cleanliness, the Gandharva their melodious voice, and Fire purity of all (limbs); therefore women are free from stains. — (Vashistha Dharmasutra 28.6)
বাংলা অর্থঃ— সোম তাদের পরিচ্ছন্নতা, গন্ধর্বর তাদের সুরঞ্জিত কণ্ঠস্বর, এবং সমস্ত (অঙ্গ) আগুন বিশুদ্ধতা দিয়েছেন। তাই নারীরা দাগ থেকে মুক্ত।
অনুবাদঃ— নারীরা সোমা থেকে তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, গন্ধর্বদের তাদের সুরযুক্ত কণ্ঠস্বর দিয়েছিল এবং আগুনের বিশুদ্ধতা (অঙ্গ) দিয়েছে; সুতরাং নারীরা দাগ থেকে মুক্ত হয়। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র, ২৮/৬)
সনাতন ধর্মের নারীজাতি সোম থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত, গন্ধর্বদের থেকে সুমিষ্ট বাক্য প্রাপ্ত, অগ্নির কাছ থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত (সর্বাঙ্গে)। তাই নারীরা সবসময় কলুষতা থেকে মুক্ত।
Pure is the mouth of a goat and of a horse, pure is the back of a cow, pure are the feet of a Brâhmana, but women are pure in all (limbs). — (Vashistha Dharmasutra 28.9)
বাংলা অর্থঃ— একটি ছাগল এবং একটি ঘোড়া মুখ শুদ্ধ, একটি গরুর পিছনে বিশুদ্ধ, বিশুদ্ধ একটি ব্রাহ্মণ এর ফুট, কিন্তু মহিলাদের সবই (অঙ্গ) বিশুদ্ধ হয়।
অনুবাদঃ— ছাগ ও অশ্বের মুখাবয়ব শুদ্ধ, গো জাতির পৃষ্ঠদেশ শুদ্ধ, ব্রাহ্মণের পাদদেশ শুদ্ধ, কিন্তু নারী জাতির সবই শুদ্ধ (সকল অঙ্গ)।
নারী অপবিত্র নয়, নারী পবিত্র সনাতন ধর্মে পরমপুরুষ মনুর মতে মনুসংহিতায় সিদ্ধান্ত—
নারীরা কখনোই অপবিত্র নন। মাসের নির্দিষ্ট সময়ে সাময়িক অসুবিধা তাদের সমস্ত মনের পাপ ধুয়েমুছে সাফ করে পবিত্রতা আরো বৃদ্ধি করে। (বশিষ্ট ধর্মসূত্র ২৮/৯)
ঋতুকালীন সময়ে মৈথুন নিষিদ্ধঃ—
সমানশয়নে চৈব ন শ্যীত তয়া সহ।
রজসাভিপ্লু তেজো বলঃ চক্ষুরায়ুশ্চৈব প্রহীয়তে।।
(মনুসংহিতা, ৪/৪০)
অনুবাদঃ— কামে একান্ত উন্মত্ত হইলেও রাজোদর্শনে নিষিদ্ধ দিনত্রয়ে স্ত্রীগমন করিবে না, এবং তাহার সহিত সহবাস করিবে না।
নারীদের পূজা করেই সব জাত বড় হয়েছে, যে দেশে, যে জাতে নারীদের পূজা নেই, সে দেশে সে জাত কখনো বড় হতে পারেনি, কস্মিন কালেও পারবে না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে। তার প্রধান কারন- এইসব শক্তি মূর্তির অবমাননা করা।
(চিরজাগ্রত স্বামি বিবেকানন্দ)।
যে জাতির নারী যত পবিত্র, সেই জাতি তত উন্নত। যে জাতির পুরুষ যত সংযত, সেই জাতি তত উন্নত। তোমরা প্রকৃত উন্নতি লাভ কর।
(শ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব)।
একমাত্র সনাতন হিন্দু সমাজেই নারীকে সর্ব্বোচ্চ মর্য্যাদা দান হয়ে ছিল, তাই হিন্দু সমাজেই নারীর আদর্শ ও কীর্ত্তি-গরিমা পরিপূর্ণরূপে অতুলনীয় গৌরবে বিকশিত হয়েছিল। হিন্দুসমাজে নারীর মর্য্যাদা শুধু দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় ; হিন্দু -সমাজে নারী দেবী, ভগবতী, বিশ্বজননী। হিন্দুর চোখে নারী শুধু স্নেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধা-সন্মানের পাত্রী নয়; নারী দেবীরূপে পূজিতা। (ঋষির অনুশাসন)
অন্যকে প্রেম ও সহানুভূতির চোখর দেখতে হবে। আমরা যে পথ দিয়ে এসেছি তারাও সেই পথ দিয়ে চলছে। যদি তুমি বাস্তবিক পবিত্র হও, তবে তুমি অপবিত্রতা দেখবে কীভাবে? কারণ যা ভিতরে অপবিত্রতা না থাকলে বাইরে কখনোই অপবিত্রতা দেখতে পেতাম না।
(চিরজাগ্রত স্বামী বিবেকানন্দ)
যে নারী হিন্দুশাস্ত্রে উপদেশ দেয় তিনি 'রমণী'।
"যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।"
(মনুস্মৃতি, ৩/৫৬)
যে সমাজে নারীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয় সেই সমাজ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করে। আর যারা নারীদের যোগ্য সম্মান করে না, তারা যতই মহৎ কর্ম করুক না কেন, তার সবই নিষ্ফল হয়ে যায়।
"যত্র নার্য্যস্ত পূজ্যস্তে রমস্তে তত্র দেবতা"
নারী যে সমাজে পূজা পান দেবতাগণ সেথায় বিরাজ করেন।
নারী হলো মঙ্গলময়ী লক্ষ্মীস্বরূপ।
(অথর্ববেদ, ৭/১/৬৪)
বৈদিক ধর্মে নারী অর্থাত্ 'মা' কে দেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা করা হয়।
(তৈত্তরীয় উপনিষদ : শিক্ষাবল্লী, ১১ অনুবাক)।
হিন্দুধর্মের প্রতিটি শাস্ত্রে নারী যেমন মাতাকে যতদূর সম্ভব মহীয়সী করিয়া প্রত্যেকটি জননীকে জগজ্জননীর প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া করা হয়।
(শ্রীশ্রী চণ্ডী, ৫/৭২-৩)
যারা নারীদের অপবিত্র বলেন তাদেরকে আমার কিছু কথা—
সনাতন ধর্মের এই অপবিত্রতা থেকেই নারী পুরুষ সবারই জন্ম হয়, যদি নারীদের থেকে জন্ম হয় তাহলে নারী পুরুষ সবাই অপবিত্র। যে ধর্মস্থানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই সেই স্থান কখনোই পবিত্র না। নারীদের পদস্পর্শ যে স্থানকে করে অপবিত্র তাহলে সে আমার কাছে কোনো পবিত্র স্থান নয় আদৌ। দেহ অপবিত্রতা আর অসতীত্ব শুধু নারীর বেলায় হয় তাহলে একই সংজ্ঞায় শৃংখলিত নয় পুরুষ, যদিও ধর্মের পাঠশালায় উজ্জ্বল তার বিপরীত শিক্ষা- প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চনারীর নাম। আজ শবরীমালা মন্দিরে নারীর পথ আগলে দাঁড়ায় যে পুরুষ সে কোন পবিত্র পুরুষ গর্ভজাত। হায় দ্রৌপদী! যুগে যুগে তোমার বস্ত্র হরনের আয়োজনে দুর্যোধনের অভাব হয় না বড্ড অপবিত্র আজ আমাদের বোধের জায়গাটি বড্ড জ্ঞানে হিসেব-নিকেশ বিবেক-বুদ্ধিতে বুঝা যায় তাই মানুষের মনে মনুষ্যত্ব বোধ নাই, ব্রাহ্মণের মাথায় শূন্যস্থানে ধর্মজ্ঞান নাই ধর্মস্থানে ধর্ম নাই।
একটি গানে ছন্দে এই কথাটি বলছি—
বেঁচে থাক শাস্ত্র-শাস্ত্রী বেদ-বিধি পদ শাস্ত্র কানা, আরেক কানা মন আমার-আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র এক নারী মা বোন আমার।
নারীদের ঋতুস্রাবকালীন, ওভালুয়েশন পিরিয়ড, মিন্সের বিষয়টা একেবারেই স্বাভাবিক এবং আমাদের সবার জন্মের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, অত্যাবশ্যক এটি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা অধিকাংশ ছেলেরা এটাকে সমাজে অপবিত্রতার কারণ মনে করে।
এমনকি সমাজের এমন কপাল ঘোচানো-ভ্রু কুঁচকানো আচরণ দেখে নারীরাও একসময় এটাকে অপবিত্রতার লক্ষ্মণ মনে করতে শুরু করে। নতুন একটি প্রাণ পৃথিবীতে আনার পূর্ব প্রক্রিয়াস্বরূপ একটি নারী যখন প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিন গুলোতে ব্যাথায় কুকড়িঁয়ে যায়, দুমড়ে মুচড়ে যায় শরীরের ভেতরের নাড়ী নক্ষত্র পুরুষ বা সমাজ তার কিছুই টের পায় না। কখনো কোন নারীর পাজামায় ভুলবশত ও ঋতুস্রাবকালীন পিরিয়ডের রক্তের বিন্দুমাত্র দাগ দেখা যায়- সমাজ দাত কেলিয়ে হাসে আর লজ্জা দেয় নারীকে। অথচ ভাবে না আমাদের সবার মা বোনেই এই দুঃসহ যন্ত্রণা + সমাজের অপবিত্র দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমাদের কে এনেছিল পৃথিবীতে আমাদের সবার মা বোনই মাসের একটা সময় এমন অস্বস্তিকর ভাবে দিন কাটায়। পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা ভ্রুঁ কুচকে আমরা তার ব্যাথা আর অস্বস্তিকে করে তুলি দ্বিগুন।
পূজা দেওয়া যাবে না, এই ছোঁয়া যাবে না, সেই করা যাবে না। আবার ডাবল স্টান্ডার্ড/সত্য এটাও যে- এই অপবিত্রতা না থাকলে কোন নারীকে জীবন সঙ্গিনী ও করা যাবে না।
সকল অপবিত্রতা আর ঘেন্নার যেন আমাদের প্রত্যেকের জন্মের হয়। কারণ পূর্বশর্ত নারীর এই ঋতুস্রাবকালীন, পিরিয়ডের মাধ্যমে সকলের জন্মের স্থান তৈরি হয়। যে পুরুষরা নারীকে অপবিত্রতা চোখে দেখেন।
কিন্তু সে পুরুষদের ক্ষেত্রে কি সাতখুন মাফ?
খুব কম ছেলেই পাওয়া যাবে যারা তাদের স্বপ্নদোষের জন্য অনুশোচনায় ভোগে কিংবা নিজের অন্যায়/খারাপ চিন্তাভাবনার ব্যাপারে কালক্ষেপণ করে। এটাকে তারা স্বাভাবিক একটা বিষয় বলেই এড়িয়ে যায় যদিও স্বপ্নদোষের মূল কারণ খারাপ/অনৈতিক চিন্তাভাবনা।
এখানে মূল কথা হলো—
সনাতন ধর্মের মেয়েদের ঋতুস্রাবকালীন/মিন্স অনৈতিক বা অপবিত্র নয় অপবিত্র-অনৈতিক ছেলেদের স্বপ্নদোষ।
সপ্নদোষকে কেন অনৈতিক বলছিঃ—
সেক্স বা যৌনতা কোন অপরাধ বা অনৈতিকতা নয়। এর প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আকর্ষণ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং তা প্রকৃতির ই নিয়ম। সেই সাথে একজন সৎ-নীতিবান-ধার্মিক ব্যক্তি চিন্তাভাবনায় সংযম ধারণ করে ব্রহ্মচর্য পালন করে উপযুক্ত পরিবেশ এবং সময়ে তার যৌন চাহিদা পূরন করবে সেটাও প্রকৃতিরই নিয়ম।
এর থেকে বিচ্যুতি অর্থ নৈতিকতার অবক্ষয় নয় কি—
অনেক ক্ষেত্রে আবার শারিরীক দুর্বলতা কিংবা অত্যাধিক মানসিক চাপেও স্বপ্নদোষ হতে পারে যা অনৈতিকতার আওতায় পড়েনা। মূলত সেক্স কে ট্যাবু করে রাখার কারণে এই বিশয়ে অজ্ঞতা থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা। আর তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের সংযম ধারণ করার ব্যাপারটা অধরাই থেকে যায়।
তো নারীদের ঋতুস্রাবকালীন মত এমন স্বাভাবিক এবং অত্যাবশ্যকীয় একটা জৈবিক প্রক্রিয়া নারীদের পাশে না দাঁড়িয়ে উলটো অপবিত্রতার দোহাই দিয়ে পূজা অর্চনা ও ধর্মীয় কাজকর্মে বাধা দেওয়াটা কি ধর্মসঙ্গত হতে পারে?
এটা অজ্ঞতা বা কুসংস্কারেরই ফল?
আমাদের সনাতন ধর্ম চিরন্তন বৈশিষ্ট্যাবলী। আর নারীদের ঋতুস্রাবকালীন নতুন প্রাণের আগমনী বার্তাবাহক এটা সনাতন ধর্মে চিরন্তন সত্য। নারী পূজায় অংশগ্রহণ করবে কি না তা সম্পূর্ণরূপে ঐ বিষয়টি নারীদের উপরই সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত যিনি এমন কষ্টদায়ক পরিস্থিতি ভোগ করছেন। কষ্ট উপেক্ষা করে যদি তিনি মনকে ঈশ্বরের কাজে সমর্পণ করতে না পারেন তবে আপনি আমি তাকে বাধা দেবার কে?
নারীদের অপমান করা মানে নিজের মা বোনকে অপমান করা। আর সনাতন হিন্দু সমাজে নারীর মর্য্যাদা অতুলনীয়।
তুচ্ছানাং যদ কুলশ্চ, নারীনাং এব ভবেৎ।
বিনাশং স কুলধর্ম অধোগতিম প্রাপ্সসি এতৎ।।
অনুবাদঃ— এই জগতে যে কুল বা সমাজে নারীদের তুচ্ছজ্ঞান করে, সে কুল বা সমাজ ধর্মভ্রষ্ট হয়ে নরকগামী হয়।।
দেশ ও নারী দুটোকেই মাতৃরুপে দেখা উচিত।
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীরাম,
হর হর মহাদেব।
পবিত্র বেদের বাণী ও সকল বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে পেতে আমার সাথে এবং আমাদের পেইজের সাথে থাকুন।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার