সনাতন ধর্মে বিবাহের ক্ষেত্রে কোনো বর্ণের ভেদাভেদ নেই, সকল বর্ণ বিবাহ সম্পর্ক করিতে পারেন। সনাতন সংস্কৃতি মতে বাঙ্গালীর উৎপত্তি দ্বিতীয়, পূর্ব্বে অনুলোম প্রতিলোম বিবাহের রীতি ছিল; ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের কন্যাকে, ক্ষত্রিয় বৈশ্যের কন্যাকে বিবাহ করতে পারতেন। তাই এটাকে অনুলোম বিবাহ বলতেন। এইরূপ অধঃস্থজাতীয় পুরুষ শ্রেষ্ঠজাতীয় বিবাহ করলে, প্রতিলোম বিবাহ বলতেন। ইহার বিধি মন্বাদিতে আছে। যেখানে বিবাহ বিধি ছিল, সেখানে অবশ্য বৈধ বিবাহ ব্যতীতও অসবর্ণ সংযোগে সন্তানাদি জন্মিত। তাদের চতুর্বর্ণের মধ্যে স্থান পাইতো না। ভগবান মনু মনুসংহিতা বলিয়াছেন, চতুবর্ণের ভিন্ন পঞ্চম বর্ণ নাই।
যে, সঙ্কীর্ণ জাতিগণ অশ্বতরবৎ মাতা বা পিতার জাতি হইতে ভিন্ন; তাদের জাত্যন্তর বলিয়া তাহাদিগের বর্ণত্ব নাই। এইরূপ অসবর্ণ পরিণয়াদিতে যারা জন্মিত, তাদের দেখা যাক—
"ব্রাহ্মণদ্বৈশ্যকন্যায়ামম্বষ্ঠো নাম জায়তে।
নিষাদঃ শূদ্রকন্যায়াং যঃ পারশব উচ্যতে ॥"
(মনুসংহিতা, ১০/৮)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ দ্বারা বৈশাতে উৎপাদিত অম্বষ্ঠ নামে সন্তান জন্মে এবং শুদ্ৰাতে উৎপাদিত নিদসংজ্ঞক সন্তান পারশব নামে কথিত হয়।
বিশ্লেষণ করছি, বৈশ্যকন্যার গর্ভে ব্রাহ্মণ হইতে অম্বষ্ঠের জন্ম, আর শূদ্রকন্যার গর্ভে ব্রাহ্মণ হইতে নিষাদ বা পারশবের জন্ম।
"ক্ষত্রিয়াচ্ছ্দ্রকন্যায়াং ক্রুরাচারবিহারবান্।
কত্রশূদ্রবপুর্জন্তুরুগ্রো নাম প্রজায়তে ॥"
(মনুসংহিতা, ১০/৯)
অর্থাৎ, ক্ষত্রিয় থেকে শূদ্ৰাতে উৎপন্ন সন্তান ক্রুরাচার ও ক্ররকর্মরত ক্ষত্রিয় ও শূদ্রস্বভাব উগ্র নামক পুত্র জন্মে।
"বিপ্রস্য ত্ৰিষু বর্ণেষু নৃপতের্বর্ণর্য়োদ্ধয়োঃ।
বৈশ্যস্য বর্ণে চৈকস্মিন্ ষড়েতেহপসদাঃ স্মৃতাঃ ॥"
(মনুসংহিতা, ১০/১০)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণের (ক্ষত্রিয়াদি) তিন বর্ণে, ক্ষত্রিয়ের দুই (বৈশ্য ও শূদ্রে) বর্ণে ও বৈশ্যের এক (শূদ্র) বর্ণে জাত—এই ছয় জন অপসদ নামে স্মৃত।
"ক্ষত্রিয়াদ্বিপ্রকন্যায়াং সুতো ভবতি জাতিতঃ।
বৈশান্মগধবৈদেহৌ রাজবিপ্রাঙ্গনাসুতৌ ॥"
(মনুসংহিতা, ১০/১১)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণীতে ক্ষত্রিয় দ্বারা উৎপাদিত পুত্ৰ জাতিতে হয় সূত, বৈশ্য দ্বারা ক্ষত্রিয়াতে হয় মাগধ, বৈশ্য দ্বারা ব্রাহ্মণীতে হয় বৈদেহ।
"শূদ্রাদায়োগবঃ ক্ষত্তা চাণ্ডালশ্চধমো নৃণাম্।
বৈশ্যরাজন্যবিপ্রাসু জায়ন্তে বর্ণসঙ্করাঃ ॥"
(মনুসংহিতা ১০/১২)
অর্থাৎ, শূদ্রদ্বারা বৈশ্যাজাত সন্তান হয় আয়োগব, ক্ষত্রিয়াজাত হয় ক্ষত্তা, ব্রাহ্মণীজাত হয় মানুষের মধ্যে অধম চণ্ডাল। শূদ্র দ্বারা বৈশ্যা, ক্ষত্রিয়া ও ব্রাহ্মণীতে যে সন্তান হয় তারা (প্রতিলোম) বর্ণসংকর জাতি হয়।
বিশ্লেষণ করছি, বৈশ্যার গর্ভে শূদ্র হইতে আয়োগব, ক্ষত্রিয়ার গর্ভে আর শূদ্র হইতে ক্ষত্তা, আর ব্রাহ্মণকন্যার গর্ভে শূদ্র হইতে চণ্ডালের জন্ম।
যে সকল ব্রাহ্মণাদি দ্বিজ অব্রত হইয়া পতিত হয়, মনু তাহাদিগকে ব্রাত্য বলিয়াছেন। এবং ব্রাহ্মণ ব্রাত্য, ক্ষত্রিয় ব্রাত্য এবং বৈশ্য ব্রাত্য হইতে নীচজাতির উৎপত্তির কথা লিখিয়াছেন। মহভারতে অনুশাসন পর্ব্বে ব্রাত্যদিগকে ক্ষত্রিয়ার গর্ভে শূদ্র হইতে জাত বলিয়া বর্ণিত আছে।
এই সকল সঙ্করবর্ণ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্যের মধ্যে স্থান পায় নাই, ইহা একরূপ নিশ্চিত এবং এরা যে শূদ্রের মধ্যে স্থান পেয়েছিল, তাদেরও স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। আয়োগব বা ব্রাত্য এক্ষণে বাঙ্গালায় নাই; কখন ছিল না সন্দেহ; কেন না, ক্ষত্রিয় বৈশ্য বাঙ্গালায় কখনো আসে নাই। কিন্তু চণ্ডালেরা বাঙ্গালায় অতিশয় বহুল; বাঙ্গালী শূদ্রের তার একটি প্রধান ভাগ। চণ্ডালেরা অন্ততঃ মাতৃকুলে আর্য্যবংশীয়। বাঙ্গালায় শূদ্রজাতি অনেকেরই সঙ্করবর্ণ; সঙ্করবর্ণ হইলেই যে তাহাদের শরীর আর্য্যশোণিত, হয় পিতৃকুল, নয় মাতৃকুল হইতে আগত হইয়া বাহিত হইবে, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। বাঙ্গালায় অম্বষ্ঠ আছে, তাদের যে উভয় কুলে বিশুদ্ধ আর্য্য, তাদের প্রমাণ উপরে দেওয়া হয়েছে। কেন না, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র উভয়েই বিশুদ্ধ আর্য্য।
"ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চম ॥"
(মনুসংহিতা, ১০/৪)
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণ দ্বিজ। চতুর্থ শূদ্রের একজন্ম (দ্বিজত্ব নেই); পঞ্চম বর্ণ নেই।
“পঞ্চমঃ পুনবর্ণো নাস্তি। সঙ্কীর্ণজাতীনাং অশ্বরবৎ মাতাপিতৃজাতিব্যতিরিক্তজাত্যন্তরত্বাৎ ন বর্ণত্বং।”
তৃতীয়, আমরা শেষ তিন পরিচ্ছেদে যাহা বলিলাম, তাহা হইতে উপলব্ধি হইতেছে যে, বাঙ্গালায় শূদ্রমধ্যে কতকগুলি বিশুদ্ধ আর্য্যবংশীয় এবং কতকগুলি আর্য্যে অনার্য্যে মিশ্রিত, পিতৃমাতৃকুলের মধ্যে এক কুলে আর্য্য, আর কুলে অনার্য্য।
চতুর্থতঃ, কতকগুলি শূদ্রজাতি প্রাচীন কাল হইতে আর্য্যজাতিমধ্যে গণ্য, কিন্তু আধুনিক বাঙ্গালায় তাহারা শূদ্র বলিয়া পরিচিত; যথা বণিক্। বণিকেরা বৈশ্য; তাহার প্রমাণ প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে পর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। বোধ হয়, কেহই তাহাদিগের বৈশ্যত্ব অস্বীকার করিবেন না। বাঙ্গালায় শূদ্রমধ্যে যে বৈশ্য আছে, তাহার ইহাই এক অখণ্ডনীয় প্রমাণ।
পবিত্র বেদ মন্ত্রে বলছে,
ওঁ ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।।
(যজুর্বেদ, ৩১/১১)
পদার্থ : (অস্য) সেই পরমত্মার সৃষ্টিতে (ব্রাম্মণঃ) বেদের জ্ঞাতা ও ঈশ্বরের উপাসক ব্রাহ্মণ ( মুখম্) মুখের তুল্য (অসীম) হয়। (বাহু) বাহুর তুল্য বল ক্ষমতাযুক্ত পরাক্রমশালী (রাজন্যঃ) ক্ষত্রিয় হিসেবে (কৃতঃ) সৃষ্টি করেছেন। (যৎ) যিনি (উরু) উরুর তুল্য বেদ্যগাগী কর্ম করেন, (তদ্) সেই ব্যক্তি (অস্য) এই পরমত্মার নিকট (বৈশ্যঃ) বৈশ্যরূপে পরিচিতি হয়। (প্দ্ভ্যাম্) পাঁযের সমান পরিশ্রমী অবং অভিমান রহিত, সেবার যোগ্য ব্যক্তি (শুদ্রঃ) শুদ্র বলে পরিচিত হন। (অজায়ত) এভাবেই সকলের উৎপন্ন হয়েছে।
অনুবাদ— সেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহুদ্বয় হইতে ক্ষত্রিয়, উরুদ্বয় হইতে বৈশ্য এবং পাদদ্বয় হইতে শূদ্র উৎপন্ন হইল।
ভাবার্থ— যাঁহারা মস্তিষ্ক বা বুদ্ধি বল দ্বারা সমাজ সেবা করেন তাঁহারা ব্রাহ্মণ, যাঁহারা বাহুবল দ্বারা সমাজসেবা করেন তাঁহারা ক্ষত্রিয়, যাঁহারা কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য দ্বারা সমাজের পুষ্টিসাধন করেন তাঁহারা বৈশ্য এবং যাঁহারা সমাজের পাদ, ভিত্তি বা আশ্রয় স্বরুপ তাঁহারা শূদ্র।
বিশ্লেষণ করছি, যে মানুষ বেদবিদ্যা শম-দমাদি উত্তম গুনে মুখ্য, ব্রহ্মের জ্ঞাতা এবং মুখের মাধ্যেমে জগৎকে জ্ঞানদান করেন তিনি ব্রাহ্মণ। যিনি অধিক পরাক্রমশালী বাহুর তুল্য কার্যসিদ্ধ করেন তিনি ক্ষত্রীয়, যিনি ব্যাবহার বিদ্যায় প্রবীন হয়ে উরুর ন্যায় জগৎকে ধারণ করেন তিনি বৈশ্য এবং যিনি সেবায় প্রবীন, কর্মে কঠোর তিনি পায়ের ন্যায় পরিশ্রমী শূদ্র। এই বর্ণ ব্যবস্তা কর্ম অনুসারে বেদে কথিত হয়েছে।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ৷
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্৷৷
(গীতা, ৪/১৩)
অর্থাৎ, প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং কর্ম অনুসারে আমি মনুষ্য সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমিই এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আমি সবাইকে গুণ ও কর্মানুসারে চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছি।" এই চারবর্ণ হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। ব্রাহ্মণের স্বভাবজ কর্ম হলো, শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষান্তি, আর্জ্জব, ঞ্জান, বিঞ্জান ও আস্তিক্যবুদ্ধি। যা সত্ত্বেও গুণময়। সত্বগুণের গৌনাধিকারে ও রজোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব ক্ষত্রিয়। এদের কর্ম শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দাক্ষ্য, অপলায়ন, দান ও ঈশ্বর ভাব। তমোগুণের গৌনাধিকার ও রজোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব বৈশ্য। এদের কর্ম কৃষি, গোরক্ষা ও বানিজ্য। পরিশেষে তমোগুণের মুখ্যাধিকারে সৃষ্ট জীব হয় শূদ্র। সকল কাজে এদের সেবা করা তাই বলে শূদ্র কখনো ব্রাহ্মণাদির ক্রীতদাস নয় তারা জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের সম্পর্কে এক এবং তারা সবাই কর্মে আলাদা হলেও বর্ণে নয় ঈশ্বরের সৃষ্টিতে সবাই মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
মহর্ষি অত্রি স্বকীয় সংহিতায় ব্রাহ্মণকে দশ শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যা হলোঃ— দেবব্রাহ্মণ, মুনিব্রাহ্মণ, দ্বিজব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ব্রাহ্মন, বৈশ্যব্রাহ্মণ, শূদ্রব্রাহ্মণ, নিষাদব্রাহ্মণ, ম্লেচ্ছব্রাহ্মণ, চন্ডালব্রাহ্মণ ও পশুব্রাহ্মণ।
ঋগ্বেদ-সংহিতায় একটি বিশিষ্ট মন্ত্রে বলা হয়েছে যে পরম পুরুষের মুখ হতে ব্রাহ্মণ, বাহু হতে ক্ষত্রিয়, ঊরু হতে বৈশ্য এবং চরণ হতে শুদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই চতুরাঙ্গের ব্যবহার ও কর্ম অনুসারেই চতুর্বর্ণের কর্ম নির্দিষ্ট। শুধু ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত হলেই যে সে ব্রাহ্মণ হবেন, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। যদি তার মধ্যে ব্রাহ্মণের গুণ-কর্ম না থাকে, তবে সে শুদ্রের হিসেবেই গন্য। পক্ষান্তরে শুদ্রের বংশোদ্ভূত হলেও যদি তার মধ্যে ব্রাহ্মণের গুণাবলী দৃষ্ট হয়, তবে সেই ব্রাহ্মণ হন। এই প্রসঙ্গে মহাত্মা মনু বলেছেন, "যাঁহারা দ্বিজ বলিয়া পরিচয় দেন, তাঁহারা যদি বেদ অধ্যায়ন না করিয়া অসৎপথে চলেন, তবে বাস্তবিকই তাঁহারা শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হন।"
বিয়ের সাথে সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠান কবে থেকে শুরু হয়?
আমাদের সনাতন ধর্মের সংস্কৃতি মতে বিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান যা বেদের সময়ে এই বিবাহ আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। বৈদিক সংহিতা যুগের পরে বিবাহ অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত বেশিরভাগ আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। কয়েকশ বছর আগে পর্যন্ত তারা বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তন করতে থাকে।
সনাতন ধর্ম বিয়ে যুগে যুগে ও আদি যুগে থেকে ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত সৃষ্টি হয়েছে। সনাতন ধর্মে বিবাহপ্রথা ধর্মশাস্ত্রেরই একটি পবিত্র সামাজিক পরিণয়। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই বিয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হলেও শাস্ত্রীয় বিধানে বৈদিক যুগ থেকেই বিবাহ নারী-জীবনের প্রধান প্রাপ্তি ও পরম সার্থকতা বলে বিবেচিত। ঋগ্বেদে বিয়ের সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ আছে।
মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্মবিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন।
বাঙালি হিন্দু বিবাহ বলতে সাধারণত বোঝানো হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা-সহ বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নানা প্রান্তে বসবাসকারী সনাতন হিন্দু ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে হওয়া শাস্ত্রীয় বিধি ও পারিবারিক ঐতিহ্যগত প্রথাসম্মত পবিত্র সামাজিক পরিণয়কে। উচ্চবর্ণীয় হিন্দু সমাজের বিবাহে প্রধানত দু’টি আচার-উপাচারগত বিভাগ পরিলক্ষিত হয়। যথা— বৈদিক এবং লৌকিক। লৌকিক আচারসমূহ ‘স্ত্রী আচার’ নামে পরিচিত। বৈদিক আচার অন্তর্ভুক্ত অবশ্যপালনীয় প্রথাগুলি হল: কুশণ্ডিকা, লাজহোম, সপ্তপদী গমন, পাণিগ্রহণ, ধৃতিহোম ও চতুর্থী হোম। বৈদিক আচারগুলির সঙ্গে লৌকিক আচারগুলির কোনও সম্পর্ক নেই। লৌকিক আচারগুলি অঞ্চল, বর্ণ বা উপবর্ণভেদে এক-এক প্রকারের হয় থাকে। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে লৌকিক আচার তো বটেই, বিবাহের মৌলিক আচারগুলির ক্ষেত্রেও সম্প্রদায়ভেদে পার্থক্য লক্ষিত হয়। বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ আচার-রীতিকে সাধারণত দু’-ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে৷ যথা: ঘটি এবং বাঙাল আচার-অনুষ্ঠান৷
সনাতন হিন্দুশাস্ত্রমতে, বিয়ে শুধুই চুক্তি নয়, বরং একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। হিন্দু আইন মূলত হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন। শাস্ত্রানুযায়ী পুরুষদের অবশ্য পালনীয় ১০টি ধর্মীয় কর্তব্যের (Ten sacraments) অন্যতম হলো বিয়ে। হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে হলো, ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন। হিন্দু আইনানুযায়ী কনের বাবা-মা বরের হাতে কনেকে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেন। সনাতন হিন্দু আইনানুযায়ী কনের সম্মতি কিংবা অসম্মতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত নয়, যদিও পরাশর সংহিতা বা কিছু কিছু পুরাণেও নারীদের পুনর্বিবাহের বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান দেওয়া আছে—
"নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চরাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।।"
পরাশর সংহিতার এই শ্লোকের অর্থ হল, স্বামী যদি দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ হন, মারা যান, প্রব্রজ্য অবলম্বন করেন, ক্লীব, অথর্ব বা পতিত হয়, তাহলে এই পাঁচপ্রকার আপদকালীন পরিস্থিতিতে নারী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে শাস্ত্রীয় মতে বিবাহ করতে পারেন।
কিন্তু এ বিধানের বহু অপব্যাখ্যা অতীতে করা হয়েছে বা "প্রক্ষিপ্ত" বলে নস্যাৎ করা হয়েছে। এমনকি ধর্ম পরিবর্তন, বর্ণচ্যুতি, ব্যভিচার কিংবা বেশ্যাবৃত্তিও বিবাহ-বিচ্ছেদের কোনো কারণ হতে পারে না। তাই জাতপাত দূর করুন, হিন্দু হলে বিয়ে করুন। এটাই হলো আমাদের সনাতন ধর্মের প্রকৃত ভাষা।
জন্মসূত্রে আমরা কেউ ব্রাহ্মণ নই, কেউ ক্ষত্রিয় নই, কেউ বৈশ্য নই, কেউ শূদ্র নই। সনাতন ধর্মের সমস্ত মানুষ জাতির বেদ অনুযায়ী চলাই উচিত এবং অন্যকেও বেদ অনুসারে চালনা করা উচিৎ।
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
শ্রী বাবলু মালাকার,
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম,
হর হর মহাদেব।

0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার