আমাদের সনাতন ধর্মে এই মহাকুম্ভ মেলা কোন কোন প্রাচীন শাস্ত্র অনুসারে কুম্ভমেলা প্রথম আয়োজিত হয়েছিল সত্যযুগে। তবে সত্যযুগে প্রথম মহাকুম্ভ ঠিক কবে এবং কোথায় আয়োজিত হয়, তা স্পষ্ট ভাবে কোথাও উল্লেখ করা নেই। সমুদ্র মন্থনের পর থেকেই কুম্ভমেলা আয়োজিত হয় বলে প্রচলিত বিশ্বাস। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন যে কুম্ভমেলা ৮৫০ বছরের বেশি পুরোনো। আদি শঙ্করাচার্যের হাত ধরে প্রথম কুম্ভমেলা শুরু হয় বলে জানা যায়। আবার ইতিহাসবিদদের অনেকে বলেন যে গুপ্তযুগে কুম্ভমেলা প্রথম আয়োজিত হয়। সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমলেও কুম্ভ আয়োজিত হত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইতিহাসে এই মহাকুম্ভ মেলার উল্লেখ সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমলে যে কুম্ভমেলার আয়োজন হত, তার প্রামাণ্য নথি পেয়েছেন ইতিহাসবিদরা। প্রখ্যাত চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর ভারত সফর সম্পর্কিত গ্রন্থে মহাকুম্ভ মেলার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রয়াগে তিন নদীর সঙ্গমে হর্ষবর্ধন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কুম্ভমেলার আয়োজন করতেন। সেখানে তিনি নিজের সর্বস্ব, এমনকি পরনের বস্ত্রটুকুও দান করে দিতেন। মহাকুম্ভের রহস্য সমুদ্র মন্থনের কথা শিব পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ সহ প্রায় সব পুরাণেই উল্লেখ আছে। সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃত কলস উঠে আসে। অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে সংঘাত বাধে। অসুররা অমৃত কলস দখল করলে বিষ্ণু মোহিনী রূপ নিয়ে অসুরদের ভুলিয়ে কলস ফিরিয়ে আনেন। অমৃতের অধিকার নিয়ে সংঘাত তীব্র হলে দেবরাজ ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্তর হাতে কলস তুলে দেন বিষ্ণু। জয়ন্ত কাকের রূপ নিয়ে কলস ঠোঁটে করে উড়ে যান। সেই সময় কয়েক ফোঁটা অমৃত চার জায়গায় চলকে পড়ে। এই চারটি স্থান হল প্রয়াগরাজ, উজ্জয়িন, হরিদ্বার ও নাসিক। যেখানে যেখানে অমৃতের ফোঁটা পড়েছিল, সেখানে সেখানে কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়। পুরাণ অনুসারে জয়ন্ত কাকের রূপে অমৃত ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তাঁর মুখে কিছুটা অমৃত লেগে গিয়েছিল। সেই কারণে কাকেদের দীর্ঘ জীবন হয় এবং বলা হয়ে থাকে যে দুর্ঘটনা ছাড়া কাকের মৃত্যু হয় না। এছাড়া দুর্বাঘাসের উপরেও অমৃতের ফোঁটা পড়েছিল। তাই দুর্বাঘাস অত্যন্ত পবিত্র ও গণেশ পূজায় দুর্বাঘাস লাগে। এবং সকল পূজায় দুর্বাঘাস দিয়ে পূজা করা হয়।
প্রয়াগরাজেই কেন মহাকুম্ভ করা হয়?
প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ আয়োজিত হওয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। কারণ এখানেই গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গম রয়েছে। তাই এই স্থানের গুরুত্ব অন্য তিন স্থানের চেয়ে বেশি। মনে করা হয়, শাহী স্নানের সন্ধিক্ষণে যিনি এই তিন নদীর সঙ্গমে স্থান করেন, তাঁর মুক্তিলাভ হয়। কি এবং কেন? অতি সংক্ষেপে জেনে নিন— ১৩ জানুয়ারি থেকে কুম্ভমেলা শুরু হয়ে ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে। এবারের কুম্ভকে মহাকুম্ভ বলা হয় কারণ প্রতি ১২ বছরে একবার পূর্ণকুম্ভ হয়ে থাকে এবং এরকম কুম্ভ যদি সেই স্থানে ১২ তম পূর্ণকুম্ভ হয় অর্থাৎ ১৪৪ বছর পর হয় তাহলে তাকে মহাকুম্ভ বলা হয়। প্রয়াগরাজে এটা বারো তম পূর্ণকুম্ভ তাই এটি "মহাকুম্ভ"। এর আগে ১৪৪ বছর পূর্বে প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ সংঘটিত হয়েছিল।
এই মহাকুম্ভ মেলা কেন হয় জানেন?
লক্ষ কোটি বছর পূর্বে সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃতে ভরা কলসের (কুম্ভ) দাবিদার নিয়ে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে বারোদিন ব্যাপি যুদ্ধ হয়, এই সময় কলস টানাটানির ফলে ভারতবর্ষের চারটি স্থানে অমৃত পতিত হয়। ঐ চারটি স্থান হল- হরিদ্বারের গঙ্গা, প্রয়াগরাজের গঙ্গা যমুনা স্বরসতীর ত্রিবেণী সঙ্গমে, উজ্জ্বয়নীর শিপ্রা নদী এবং নাসিকের তীর্থ গোদাবরী নদী। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে এই অমৃত লাভের যুদ্ধ তাঁদের সময়ানুসারে বারো দিন চলেছিল যা আমাদের মনুষ্যলোকে ১২ বছরের সমান কারণ দেবলোকের ১দিন= মনুষ্যলোকের একবছর। প্রতি ১২ বছর পর যখন চন্দ্র, সূর্য এবং বৃহস্পতি নির্দিষ্ট রাশিচক্রে অবস্থান করে তখন এই কুম্ভস্নান অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতি সূর্যের চারপাশে তাঁর আবর্তন পূর্ণ করতে সময় নেয় ১১ বছর ১০ মাস, ১৪ দিন এবং তারপরে কক্ষপথে যে কোনও নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরে আসে এটিই মনুষ্য মানের ১২ বছরের রাশিচক্র এবং সেই সময়কালই হল ১৩ জানুয়ারি থেকে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি।
এই সময়ের মধ্যে ছয়টি মুখ্য স্নান হল—
১৩ ই জানুয়ারি পৌষ পূর্ণিমার স্নান।
১৪ ই জানুয়ারি মকরসংক্রান্তি স্নান।
২৯ শে জানুয়ারি মৌনী অমাবস্যা স্নান।
২/৩ রা ফেব্রুয়ারি বসন্ত পঞ্চমী স্নান।
১২ ই ফেব্রুয়ারি মাঘী পূর্ণিমা স্নান।
২৬ শে ফেব্রুয়ারি মহাশিবরাত্রি স্নান।
মহাকুম্ভ মেলা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থযাত্রা, যা প্রতি ৩, ৬, ১২ এবং ১৪৪ বছরে একবার পালিত হয়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে পরিচিত। মেলাটি চারটি তীর্থস্থানে অনুষ্ঠিত হয়: প্রয়াগরাজ যেখানে গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর মিলন, হরিদ্বার গঙ্গা নদী, নাসিক গোদাবরী নদী এবং উজ্জয়িনী শিপ্রা নদী। ২০২২ সালে, ৭০০ বছরের বিরতির পর হুগলির বাঁশবেড়িয়া আবার কুম্ভ মেলার আয়োজন করা হয়।
এরপর পুনরাবৃত্তি প্রতি তিন বছর অন্তর কুম্ভ মেলা করা হয়। প্রতি ছয় বছর অন্তর (অর্ধকুম্ভ মেলা)। প্রতি বারো বছর (পূর্ণকুম্ভ মেলা)। প্রতি ১৪৪ বছর পর (মহাকুম্ভ মেলা)।
অর্ধকুম্ভ, কুম্ভমেলা, পূর্ণকুম্ভ আৰু মহাকুম্ভ মাজৰ পাৰ্থক্য কি?
অর্ধকুম্ভ,
অর্ধকুম্ভ হচ্ছে ধর্মীয় আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। হরিদ্বার আবার প্ৰয়াগরাজতে অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ পরার মতো অত্যন্ত পবিত্ৰ বলে গণ্য করা হয় গঙ্গা, যমুনা আবার সরস্বতী নদীর সংগমস্থলীত সংঘটিত হয়। অৰ্ধকুম্ভর গুরুত্ব অধিক কারণ ইয়াকে কুম্ভমেলার আধার চক্ৰ বলে গণ্য করা হয়। লাখ লাখ ভক্ত ইয়াতে স্নান করেন। কারণ এই সময়ে সংগমতে স্নান করলে পাপ নাশ হয় আবার মোক্ষ লাভ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। ইয়াতে পরিঘটনার সময়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানরের গণনার উপর ভিত্তি করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানরের মতে বৃহস্পতি বৃশ্চিক রাশিতে আবার সূৰ্য্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে, অৰ্ধকুম্ভ সংগঠিত হয়।
কুম্ভমেলা,
কুম্ভমেলা হচ্ছে বিশ্বের সৰ্ববৃহৎ ধর্মীয় আবার সাংস্কৃতিক উৎসর, প্রতি ১২ বছরের এই স্থান হরিদ্বার, প্ৰয়াগরাজ, উজ্জয়িন আবার নাশিকতে অনুষ্ঠিত হয়। আবার ইয়াক ভারতীয় সংস্কৃতি আবার বিশ্বাসের প্ৰতীক হিসাবে গণ্য করা হয়। কুম্ভমেলার পৌরাণিক কাহিনী সাগরের মন্থনর সঙ্গে জড়িত, যা অমৃতরের-অসুরের মহাজগতে সংগ্ৰাম হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানরের মূল আকর্ষণ হচ্ছে পবিত্র নদীত গা ধোয়ার, যা অমৃত স্নান বলা হয়।
পূর্ণকুম্ভ,
পূর্ণকুম্ভ মেলা হচ্ছে প্ৰয়াগরাজত প্ৰতি ১২ বছরের অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভমেলা সম্প্ৰসারণ। ইয়াকে কুম্ভর পূৰ্ণ রূপ বুলি গণ্য করা হয়। আবার ইয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কুম্ভমেলা বলা হয়েছে। পবিত্র গঙ্গা, যমুনা আবার সরস্বতী নদীর সংগমস্থলীতে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মার শুদ্ধি আবার মোক্ষ লাভ।
মহাকুম্ভ,
মহাকুম্ভ মেলা ভারতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আটাইতকৈ ডাঙৰ উৎসৱ, প্ৰতি ১৪৪ বছরের প্রয়াগরাজতে এটা অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াকে কুম্ভমেলা পবিত্ৰ আবার গুরুত্বপূৰ্ণ রূপ বলে গণ্য করা হয়। ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসরি এই মেলার সময়ে সংগমতে স্নান করিলে আত্মা শুদ্ধ হয় আবার পাপ মুক্ত হয়।
অবস্থান সমূহ পর্যায়ক্রমে—
প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, নাশিক, উজ্জয়িনী, বাঁশবেড়িয়া।
মহাকুম্ভ মেলা নদীতে পবিত্র স্নানের মাধ্যমে পালিত হয়। তবে এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি সম্প্রদায়ের বাণিজ্য, মেলা, শিক্ষা, সাধুদের ধর্মীয় বক্তব্য, সন্ন্যাসীদের সমাবেশ এবং বিনোদনের মিলনমেলাও তীর্থযাত্রীরা বিশ্বাস করেন যে এই নদীগুলিতে স্নান করা তাদের অতীত পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত এবং শুদ্ধি সাধনের একটি উপায়, যা তাদের পাপমুক্ত করে। এই মহাকুম্ভ মেলার প্রচলন ঐতিহ্যগতভাবে ৮ম শতাব্দীর হিন্দু দার্শনিক ও সাধু শ্রী আদি শঙ্করাচার্যের সঙ্গে যুক্ত। তিনি ভারতজুড়ে বিভিন্ন মঠ ও ধর্মীয় সমাবেশে দার্শনিক আলোচনা ও বিতর্ক চালু করার প্রচেষ্টা করেছিলেন। তবে, ১৯শ শতকের আগে "কুম্ভ মেলা" নামে এই বিশাল তীর্থযাত্রার কোনও ঐতিহাসিক সাহিত্য প্রমাণ নেই। তবে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ও শিলালিপিতে বার্ষিক মাঘ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে প্রতি ৬ বা ১২ বছর পর বৃহৎ সমাবেশ হত এবং একটি পবিত্র নদী বা কুণ্ডে স্নান ছিল এর মূল আচার। গবেষক কামা ম্যাকলিনের মতে, ঔপনিবেশিক যুগের সমাজ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ওরিয়েন্টালিজমের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রাচীন মাঘ মেলাকে আধুনিক কুম্ভ মেলা হিসেবে পুনরায় ব্র্যান্ডিং করা হয়, বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর।
এই উৎসবের সময়সীমা প্রতি ১২ বছরে একবার করে প্রতি স্থানে পালিত হয়, যা হিন্দু চন্দ্র-সূর্য পঞ্জিকা এবং বৃহস্পতি, সূর্য ও চন্দ্রের আধ্যাত্মিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। প্রয়াগরাজ এবং হরিদ্বারের উৎসবের মধ্যে প্রায় ৬ বছরের পার্থক্য থাকে, এবং উভয় স্থানেই মহা (বড়) এবং অর্ধ (অর্ধেক) কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। উজ্জয়িনী এবং নাশিকের কুম্ভ মেলার সঠিক বছরগুলি ২০ তম শতাব্দীতে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাশিক এবং উজ্জয়িনীর উৎসব এক বছর অথবা এক বছরের ব্যবধানে পালিত হয়েছে, সাধারণত প্রয়াগরাজ কুম্ভ মেলার প্রায় ৩ বছর পর। ভারতের অন্যান্য অনেক স্থানে, যেখানে ছোট আকারে তীর্থযাত্রা এবং স্নান উৎসব হয়, সেগুলো মাঘ মেলা, মকর মেলা বা এর সমতুল্য নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুতে, মাঘ মেলা যার স্নান রীতিটি প্রাচীন, এটি কুম্বকোনামে কাবেরী নদীর কাছে মহামাহাম ট্যাঙ্কে প্রতি ১২ বছরে পালিত হয় এবং লক্ষ লক্ষ দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দুদের আকর্ষণ করে, এবং এটিকে তামিল কুম্ভ মেলা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যান্য স্থান যেমন কুরুক্ষেত্র, সোনিপত, এবং পানাউটি (নেপাল) কোথাও মাঘ-মেলা বা মকর-মেলা স্নান তীর্থযাত্রা এবং মেলা কুম্ভ মেলা নামে পরিচিত হয়েছে।
মহাকুম্ভ কি ব্যুৎপত্তি এবং নামকরণ—
বেদ, পুরান, ভাগবত, গীতা, মহাভারত সব জায়গাতে অমৃত মন্থন ও কুম্ভ স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। সমুদ্রমন্থন হলো কুম্ভ বেদ,পুরাণ শাস্ত্রে উল্লেখিত সর্বাধিক জনপ্রিয় শ্রুতি৷ ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণসহ প্রভৃতি হিন্দু পুরাণে ও মহাভারতে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়৷ সমুদ্রমন্থনের ঘটনাটি অমৃৃত তথা অমরত্বের সন্ধান দেয়৷
বৈদিক যুগে কুম্ভ মেলার ঐতিহাসিকতা খুঁজে বের করার জন্য অথর্ব বেদ (IV.34.7; XIX.53.3) থেকে দুটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করলাম, ঋগ্বেদ থেকে তিনটি (I.8.9, X.89.7, XII.3.23) এবং যজুর বেদ থেকে একটি ( মধ্যনন্দিনা , 19.87)। অথর্ববেদের মন্ত্র গুলোর মধ্যে—
' चतुर: कुम्भांश्चतुर्धा दादामि ' এবং ' পূর্ণ: कुम्भोषधिकाल आहिस्तं'— প্রথমটি বিস্তারিত যজ্ঞের গৌরবের সাথে সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয়টি 'ঈশ্বরীয় সময়' সম্পর্কিত।
কিছু পুরাণ গ্রন্থে কুম্ভের উপস্থিতি দেখা যায়, কিন্তু কোনোটিই এটিকে উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করে না। বায়ু পুরাণ (II.15.47) এটিকে শ্রাদ্ধ (পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করার আচার) অনুষ্ঠানের জন্য একটি পবিত্র স্থান হিসাবে বর্ণনা করে । বায়ু পুরাণের এই কুম্ভটিকে নারদীয় পুরাণ (II.65.100) এ উল্লেখিত পূর্ববর্তী সরস্বতী নদীর তীরে শ্রী কুম্ভ নামে একটি স্থানের সাথে চিহ্নিত করা যেতে পারে , যেখানে একটি পবিত্র স্নান যজ্ঞ (অগ্নি পূজা) করার একই সুবিধা প্রদান করে বলে বিশ্বাস করা হয়। ) যারা এখনও এই রেফারেন্স দ্বারা বিভ্রান্ত, তাদের জন্য কাশীর শঙ্খধারার যথাযথ পর্যবেক্ষণ (12 শতক খ্রিস্টাব্দ) কার্যকর হতে পারে। তিনি বলেন, ' गुरोर्गिर:पंचदिनान्युपास्य वेदान्तशास्त्रानि दिनत्रयं च, अमी समघ्रातवित्र्कवादा: ('পণ্ডিত, যারা শিক্ষকের দেওয়া পাঠ পাঁচ দিনে, বেদ ও শাস্ত্র তিন দিনে শেখেন, তারা কেবল শুঁকে যুক্তি বা বিতর্কের জ্ঞান অর্জন করেন। ') (লতাকামেলাকাম, II.14)।
প্রয়াগরাজ, নাসিক এবং উজ্জয়নে, কুম্ভযোগ (কুম্ভের অধীনে নক্ষত্রের একটি বিশেষ সংমিশ্রণ) কুম্ভরাশিতে থাকা ( কুম্ভ রাশির চিহ্ন, বা জলের কলস) কোনো স্বর্গীয় বস্তুর সাথে সংযুক্ত নয়। প্রয়াগরাজ, নাসিক এবং উজ্জয়িনে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঐতিহ্যে কুম্ভ শব্দটি আছে, যা হরিদ্বারে উৎসবের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। নাসিক এবং উজ্জয়িনের উৎসবগুলি সিংহস্থ নামে পরিচিত, অমৃত কুম্ভ হিসাবে,মেলা নয়। কারণ বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে থাকলে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় । কুম্ভযোগের কোন জ্যোতির্বিদ্যা বা জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পাঠ্য উল্লেখ নেই। পুরাণ থেকে দেখা যায় যে কুম্ভপর্ব (কুম্ভের সময়কাল) এর নামটি এসেছে হরিদ্বারে স্নানের একটি শুভ উপলক্ষ থেকে যা প্রতি ১২ম বছরে হরিদ্বারে হয়েছিল যখন বৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে ছিল এবং সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করেছিল। হরিদ্বারে গঙ্গা স্নানের পবিত্র সময় হিসাবে এই জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংযোগটিকে নারদীয় পুরাণ (II.66.44) এবং ভবিষ্য পুরাণে (III.iv.7.37-38) উল্লেখ করা হয়েছে। এটি পরামর্শ দেয় যে মেলাটি মূলত হরিদ্বারে পালন করা হয়েছিল এবং কুম্ভ রাশিতে বৃহস্পতির সময় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে এটিকে কুম্ভ বলা হত।
সনাতন ধর্মের ভৌগলিক নদী গঙ্গার কেন্দ্রীয়তা—
অমৃতের (অমৃত) মিথের সাথে যুক্ত আরেকটি ব্যাখ্যা হল যে বৈদিক যুগে অমৃত ছিল খাদ্যশস্য, কিন্তু মহাকাব্য-পুরাণ যুগে, ব্যাখ্যাটি গঙ্গা বা জল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। খাদ্যশস্য ভারতে কৃষির প্রবর্তনের প্রতীক হলেও, জীবন-ধারণকারী গঙ্গার মহিমাকে সমুন্নত রাখার জন্য ধারণাটি পুরাণকালে পরিবর্তিত হয়েছিল—কৃষির জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ, এবং কুম্ভ মেলা এই সত্যটিকে উদযাপন করে। পৌরাণিকভাবে যে চারটি স্থানে অমৃত ছড়িয়ে পড়েছিল তার মধ্যে হরিদ্বার এবং প্রয়াগরাজ গঙ্গার তীরে অবস্থিত। এমনকি গোদাবরী নদী, যার তীরে নাসিক অবস্থিত, পুরাণে তাকে 'গৌতমী গঙ্গা' বলা হয়েছে (ব্রহ্ম পুরাণ , 78.77)। গঙ্গার সাথে উজ্জয়নের সংযোগ স্কন্দ পুরাণে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে (অবন্ত্য-খণ্ড ; Ii29,33,42), যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে শিপ্রা নদীটি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে যেখানে এটি একবার গঙ্গা দ্বারা আলিঙ্গন করেছিল। গঙ্গেশ্বর নামে একটি লিঙ্গ (একটি ফ্যালিক বস্তু) উজ্জয়নের শিপ্রার দক্ষিণ তীরেও পাওয়া গিয়েছিল। এই সমস্ত কিছুই গঙ্গার সাথে যুক্ত একটি আচারিক স্নান উৎসব হিসাবে কুম্ভ মেলার তাত্পর্যকে নির্দেশ করে, যার জল ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যযুগীয় সময়ে কুম্ভপর্বের কিংবদন্তির অজানা লেখকদের কাছে অমৃতের মতো ছিল। গুপ্ত যুগের (৪র্থ-৫ম শতক) থেকে ভারতীয় শিল্পকলায় কুম্ভ নিজেই গঙ্গার ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
একবার বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় শান্তিপূর্ণ সমাবেশগুলির মধ্যে একটি হিসাবে স্বীকৃত, কুম্ভ মেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু তীর্থস্থান হিসাবে পালিত হয়েছে। মেলাটি একটি জৈব এবং মহাজাগতিক আকারে, ভারতীয় লোক ও সংস্কৃত ঐতিহ্যের এমন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে জীবন্ত করে তোলে যা অন্য কোথাও দেখা যায় নি, যা স্থান এবং সময়ের সাথে সম্পর্কিত পবিত্রতার চূড়ান্ত অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে। প্রাচীন শাস্ত্রীয় বৈধতা নির্বিশেষে, কুম্ভ মেলা উদযাপন পবিত্র উত্থানের একটি সাক্ষ্য, এবং মানুষের আত্মার সাথে স্থান ও সময়ের একীকরণ। কুম্ভ মেলার প্রচলন ঐতিহ্যগতভাবে ৮ম শতাব্দীর হিন্দু দার্শনিক ও সাধু শ্রী আদি শঙ্করাচার্যের সঙ্গে যুক্ত।
মহাকুম্ভ মেলার সংস্কৃত কুম্ভ শব্দের আক্ষরিক অর্থ "কলস, ঘট, পাত্র"। এটি প্রায়শই জল ধারণের প্রসঙ্গে বা অমরত্বের রসায়ন অমৃত সম্পর্কিত পৌরাণিক কিংবদন্তিমূলক বৈদিক গ্রন্থে পাওয়া যায়। কুম্ভ শব্দ বা এর সিদ্ধান্তমূলক শব্দগুলো ঋগ্বেদে , উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদ ১০/৮৯/৭ ; যজুর্বেদ ১৯/১৬, সামবেদ ৬/৩, অথর্ববেদ ১৯/৫৩/৩ এবং অন্যান্য বৈদিক এবং বৈদিকোত্তর প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায়। জ্যোতিষশাস্ত্রীয় গ্রন্থে, 'কুম্ভ' শব্দটি কুম্ভ রাশির চিহ্নকেও বোঝায়। মেলা শব্দের সংস্কৃত অর্থ বিশেষ করে সম্প্রদায় উদযাপনের প্রসঙ্গে "একত্রিত হওয়া, যোগদান করা, মিলিত হওয়া, একসাথে চলা, সমাবেশ, সংযোগ"। এই শব্দটি ঋগ্বেদ এবং অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থেও পাওয়া যায়। সুতরাং, কুম্ভ মেলা মানে "জল বা অমরত্বের কারণীভূত অমৃত" এর চারপাশে "সমাবেশ, সম্মেলন বা ঐক্য"।
মহাকুম্ভ আরো ইতিহাস পাওয়া যায়—
প্রয়াগ এবং স্নান তীর্থযাত্রার প্রথম উল্লেখ ঋগ্বেদ পরিশিষ্টে (ঋগ্বেদের পরিপূরক) পাওয়া যায়। এটি বৌদ্ধ ধর্মের পালি শাস্ত্রেও উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন মঝিম নিকায়ের ধারা ১/৭-এ, বুদ্ধ বলেছেন, পয়াগ স্নান (সংস্কৃত: प्रयाग) ক্রুর এবং মন্দ কর্মসমূহ ধুয়ে ফেলতে পারে না, বরং গুণী ব্যক্তির কর্ম ও হৃদয় শুদ্ধ হওয়া উচিত। মহাভারতে অতীতের ভুল এবং অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্তের উপায় হিসাবে প্রয়াগে স্নান তীর্থযাত্রার উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে মহাযুদ্ধের পূর্বেতীর্থযাত্রা পর্বে, বলা হয়েছে "যে দৃঢ় নৈতিক ব্রত পালন করে, মাঘের সময় প্রয়াগে স্নান করে, হে ভরতর্ষভ, সে নিষ্কলঙ্ক হয়ে স্বর্গে পৌঁছে যায়।" অনুশাসন পর্বে, যুদ্ধের পরে, মহাভারত এই স্নান তীর্থকে "ভৌগোলিক তীর্থ" হিসাবে বিস্তৃত করেছে যা অবশ্যই মানস-তীর্থের (হৃদয়ের তীর্থ) সাথে মিলিত হতে হবে যেখানে ব্যক্তি সত্য, দাতব্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য এবং অন্যান্য মূল্যবোধের দ্বারা জীবনযাপন করেন।
প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে প্রয়াগ এবং নদীতীরবর্তী উৎসবের অন্যান্য উল্লেখ রয়েছে, যেখানে বর্তমান কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তবে কুম্ভ মেলার সঠিক বয়স অনিশ্চিত। ৭ম শতাব্দীর বৌদ্ধ চীনা পরিব্রাজক জুয়ানজাং (হিউয়েন সাং) রাজা হর্ষ এবং তার রাজধানী প্রয়াগের উল্লেখ করেছেন, যেটিকে তিনি শত শত " দেব মন্দির" এবং দুটি বৌদ্ধ মঠ সহ একটি পবিত্র হিন্দু শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি নদীর সংযোগস্থলে হিন্দু স্নান কর্মের কথাও উল্লেখ করেছেন। কিছু পণ্ডিতদের মতে, এটি কুম্ভ মেলার প্রাচীনতম টিকে থাকা ঐতিহাসিক বিবরণ, যা বর্তমান প্রয়াগে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল। কিছু ঐতিহ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে হিন্দু মঠগুলির সাথে দার্শনিক আলোচনা এবং বিতর্কের জন্য বড় হিন্দু সমাবেশ শুরু করার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ৮ম খ্রিস্টাব্দের দার্শনিক শঙ্করাচার্যকে কুম্ভ মেলার প্রবর্তক বলে থাকে।
কামা ম্যাকলিন- একজন ভারততত্ত্ববিদ যিনি মূলত ঔপনিবেশিক সংরক্ষণাগার এবং ইংরেজি ভাষার মিডিয়ার উপর ভিত্তি করে কুম্ভ মেলার উপর নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন, তিনি অন্যান্য পণ্ডিতদের ই-মেইল এবং ৭ম শতাব্দীর জুয়ানজাং স্মৃতিকথার আরও সাম্প্রতিক ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে বলেছেন, প্রয়াগ ঘটনা প্রতি ৫ বছর অন্তর ঘটেছিল (১২ বছর পর নয়)। বিপরীতে, এরিয়েল গ্লুকলিচ - হিন্দুধর্ম এবং ধর্মের নৃতত্ত্বের একজন পণ্ডিত দ্বারা, জুয়ানজাং স্মৃতিকথায় কিছুটা উপহাসমূলকভাবে প্রয়াগের খ্যাতি রয়েছে যেখানে লোকেরা (হিন্দু) একসময় তাদের আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কুসংস্কারপূর্ণ ভক্তিমূলক আত্মহনন করেছিল এবং কীভাবে একজন ব্রাহ্মণ আগের যুগে সফলভাবে এই অভ্যাসের অবসান ঘটিয়েছে। গ্লুকলিচ বলেছেন, এটি এবং অন্যান্য বিশদ বিবরণ যেমন মন্দির এবং জলাশয়ের নামগুলি থেকে বোঝা যায় যে জুয়ানজাং তার বৌদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে ৭ম শতাব্দীতে প্রয়াগে হিন্দু রীতিগুলি উপস্থাপন করেছিলেন সম্ভবত "চীনে তার দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য"।
হিন্দুধর্মে প্রয়াগের তাৎপর্যের অন্যান্য প্রাথমিক বিবরণ পাওয়া যায় প্রয়াগ মাহাত্ম্যের বিভিন্ন সংস্করণে। এই পুরাণ-ধারার হিন্দু গ্রন্থগুলি প্রয়াগকে "তীর্থযাত্রী, পুরোহিত, বিক্রেতা, ভিক্ষুক, পথপ্রদর্শক" এবং নদীর সঙ্গম বরাবর স্থানীয় নাগরিকদের দ্বারা পূর্ণ ব্যস্ত একটি স্থান হিসাবে বর্ণনা করে। মধ্যযুগীয় ভারতের এই সংস্কৃত নির্দেশিকা বইগুলির সংস্করণ হালনাগাদ করা হয়েছিল, সম্ভবত পুরোহিত এবং গাইডদের দ্বারা, যারা পরিদর্শনকারী তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক উপার্জনে পারস্পরিক অংশীদারিত্ব করেছিলেন। প্রয়াগ নদী এবং হিন্দু তীর্থযাত্রার তাৎপর্য সম্পর্কে দীর্ঘতম অংশগুলির মধ্যে একটি মৎস্য পুরাণের ১০৩-১১২ অধ্যায়ে পাওয়া যায়। ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে প্রথম কুম্ভ মেলা পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৭০ সালে সংগঠিত হয়েছিল। কিছু পর্যবেক্ষক কুম্ভমেলা এবং পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন।
শ্রী বাবলু মালাকার
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম,
হর হর মহাদেব।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার