বেদ (সংস্কৃত: वेद, "জ্ঞান") হল প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ একাধিক গ্রন্থের একটি বৃহৎ সংকলন। ছান্দস্ ভাষায় রচিত বেদই ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন এবং সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।
সনাতনীরা বেদকে "অপৌরুষেয়" ("পুরুষ বা লোক" দ্বারা কৃত নয়, অলৌকিক) এবং "নৈর্বক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য" (যা সাকার নির্গুণ ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় এবং যার কোনও রচয়িতা নেই। শাস্ত্র অনুযায়ী পরব্রহ্মই সৃষ্টির আদিতে মানব হিতার্থে বেদের জ্ঞান প্রকাশ করেন। সর্বপ্রথম অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চার ঋষি চার বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত হন। এবং পরবর্তিতে তাঁরা অন্যান্য ঋষিদের মাঝে সেই জ্ঞান প্রচার করেন। পুস্তক আকারে প্রাপ্ত বেদ আধুনিক হলেও এর জ্ঞান শাশ্বত তাই বেদকে শ্রুতি যা শ্রুত বলা হয়েছে। বৈদিক ঋষিরা বেদমন্ত্র মুখে মুখে উচ্চারণ করে তাদের শিষ্যদের শোনাতেন, আর শিষ্যরা শুনে শুনেই বেদ অধ্যায়ন করতেন। বেদমন্ত্র যথাযথ উচ্চারণে যে ছন্দঃশাস্ত্রের উপযােগিতা রয়েছে। তা কখনোই অস্বীকার করা যায় না তাই বেদের আদর্শ পূর্ণ জীবন মানুষী ও দৈব, ঐহিক ও আধ্যাত্মিক এই উভয় আনন্দ ও ঐশ্বর্য লাভ করাই ঋষির লক্ষ্য তাঁদের এই যুগ্মদৃষ্টি বা আদর্শকে শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, ‘double intendre’ ‘the mystic with a double significance, one exoteric the other esoteric’.
তাঁরা একদিকে যেমন চেয়েছেন পার্থিব ধন ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি, তেমনি আবার সেই সঙ্গে চেয়েছেন সত্যম্ ঋতম্ বৃহত্কে- ভূমাকে৷ জাগতিক ঐশ্বর্য আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য একে অপরের প্রতীক ও প্রকাশ৷ জীবনের এই উভয় দিককেই ঋষিরা সমান গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন৷ দেহ ও আত্মা নিয়ে যেমন একটা গোটা মানুষ, তেমনি এই দুইয়েরই চাই পরিপূর্ণতা চরিতার্থতা ও সম্যক্ সিদ্ধি৷ ব্যবহারিক জীবনের পূর্ণতাকে তাঁরা বলতেন ‘লোকসিদ্ধি’ এবং আধ্যাত্মিক জীবনের পূর্ণতাকে বলতেন ‘আত্মসিদ্ধি’৷ বেদের মধ্যে এই লোকসিদ্ধি ও আত্মসিদ্ধির সার্থক সমন্বয়৷ বলা হয়েছে—
‘অস্মালোকস্য সিদ্ধ্যর্থং কর্তব্যং চ আত্মসিদ্ধয়ে’
(মহাভারত, শান্তিপর্ব, ২২০/৪৫)৷
ধর্ম ও মোক্ষের ভিতরেই তাঁরা গ্রহণ করেছেন অর্থ ও কামকে৷ এই উভয় দিক্ নিয়েই চতুর্বর্গ৷ জীবনের এই ভিতর ও বাহিরকে ঋষিরা দেখেছেন যুগপত্ সত্যের এপিঠ আর ওপিঠ রূপে৷ তাই তাঁরা বলেছেন, বাহিরে যতগুলি আকাশ আছে অন্তর্হূদয়েও আছে ঠিক ততগুলি আকাশ৷ অন্তরেও আছে পৃথিবী স্বর্গ অগ্নি বায়ু সূর্য চন্দ্র—
যাবান বা অয়মাকাশস্তাবানেবোহন্তর্হূদয় আকাশ৷
উভে অস্মিন দ্যাবাপৃথিবী অন্তরের সমাহিতে উভাবগ্নিশ্চ বায়ুশ্চ৷৷
(ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৮/৩)।
এই পার্থিব জীবনকে ত্যাগ করে নয়, এই বাস্তব জীবনকে ধরে তার ভিতর দিয়েই বৈদিক ঋষির সাধনা৷ একটা উপমা দিয়ে সে কথা বোঝান হয়েছে- বৃহস্পতি অর্থাত্ বেদমন্ত্রবাণীর প্রদান উদগাতার সাহায্যে এই পৃথিবীরূপী গাভী থেকেই ঋষিরা তাঁদের দেহ ও ইন্দ্রিয়ের পাত্রে বেদের দুগ্ধ দোহন করেন-
‘ঋষয়ো দুদুহুর্দেবীমিন্দ্রিয়েষ্বথ সত্তমাঃ৷
বত্সং বৃহস্পতিং কৃত্বা পয়শ্ছন্দোময়ং শুচি৷’
(ভাগবত, ৪/১৮/১৪)।
নিম্নের এই অজ্ঞানের জগত্- ‘অনৃতস্য ভূরে’ (ঋগ্বেদ, ৭/৬০/৫), এখান থেকেই ঊর্ধ্বে সত্যের অমৃতধামে- ‘সদনম্ ঋতস্য’ (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৭), ঋষিদের সাধন পথে ‘ঋতস্য পন্থা’ (ঋগ্বেদ, ৩/১২/৭) এই যাত্রা৷
শ্রী বাবলু মালাকার
সনাতন সংস্কৃতি ও বেদ বেদান্তদর্শন প্রচারক,
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
0 Comments
ওঁ তৎ সৎ
নমস্কার